পূর্ব কলকাতা: লেকটাউন, বারাসত
থমকে খাল সংস্কার
দখলদারির ফাঁস
ল্লিশ বছরে প্রথম বার কাজে হাত দিয়েও সুষ্ঠু ভাবে তা করে উঠতে পারল না রাজ্য। আপার বাগজোলা খালের আমূল সংস্কারের ওই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের মার্চে। সেখানে তা শুরুই হয় মে মাসে। তার পরেও প্রকল্প রূপায়ণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে খালধার জবরদখলেরর সমস্যা। অভিযোগ, সে কাজে সাহায্য মিলছে না প্রশাসনের। অথচ, সেচ দফতর সূত্রে খবর, তিন পর্যায়ের এই কাজ সুষ্ঠু ভাবে শেষ হলে বাগজোলার দু’পারের মানুষের এবং সেই সঙ্গে শহরবাসীর জল জমার সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলত।
২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বাগজোলা খালের ৯ হাজার ২৩৫ মিটার অংশ আপার বাগজোলা। তারই সংস্কারে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫৯.১৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৫১.১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হবে জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের আওতায়। বাকি আট কোটি টাকা দেওয়ার কথা রাজ্য সরকারের। প্রকল্পের শর্তানুসারে ৫১.১৩ কোটির ৬৫ শতাংশ দিচ্ছে রাজ্য। বাকি ৩৫ শতাংশ দেওয়ার কথা কেন্দ্রের। মেট্রোপলিটন ড্রেনেজ ডিভিশন-২ সূত্রে খবর, প্রথম পর্যায়ে আপার বাগজোলার পলি নিষ্কাশন ও পাড় বাঁধানো হবে। এই পর্যায়ে খালের শুরু থেকে ৪,৯০৭ মিটার পর্যন্ত পাড় বাঁধানো হচ্ছে। বাকি অংশের পাড় মেরামতি হবে। এর পরে আরও দু’টি ধাপে বাগজোলা খাল সংস্কারের কথা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, কোথাও কোথাও ড্রেজিং করার যন্ত্র ঘোরানোর মতো যথেষ্ট জায়গা নেই। কারণ খালের মধ্যে ঢুকে আছে বেশ কিছু কাঁচা ও পাকা বাড়ি। কোথাও মেশিন চালাতে গিয়ে ফাটল ধরছে সে সব বাড়ির দেওয়ালে। কোথাও আবার ধসও নামছে। আরও অভিযোগ, খালপাড় বাসিন্দাদের একাংশ ইটপাটকেল ছুড়ে বিক্ষোভের মুখে ফেলছেন ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীদের। ফলে কাজের গতি রুদ্ধ হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকল্প। দক্ষিণ দমদম পুর-এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি, স্থানীয় বাসিন্দা দয়াময় ভট্টাচার্য বলছেন, “প্রশাসন কড়া হাতে খালপাড়ের অবৈধ বসবাস না আটকালে বাগজোলা খাল সংস্কারের কোনও ফল পাওয়া যাবে না।”
জববরদখলের সমস্যা মূলত কামারহাটি, বরাহনগর ও দক্ষিণ দমদম পুরসভার অন্তর্গত এলাকায়। কামারহাটি পুর-এলাকায় বাগজোলা খালের শুরু থেকে ৫৪০ মিটার পর্যন্ত অংশে প্রায় ২০টি কাঁচা বাড়ি। বরাহনগর পুর এলাকার খালের ৫৯৫ মিটার থেকে ৯৪৮ মিটারে খালধার লাগোয়া কালীমাতা কলোনির কিছু বাড়ি এবং ১,২১০ মিটার থেকে ৩,০৪৮ মিটার অংশে সতীন সেন নগর ও নোয়াপাড়া এলাকায় খালের মধ্যে ঢুকে যাওয়া কিছু কাঁচা ও পাকা বাড়ি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ দমদম পুরসভার অন্তর্গত বেদিয়াপাড়া এলাকায় খালের ৩,৫০০ থেকে ৪,০০০ মিটার পর্যন্ত অংশে ৩০টি বাড়িও এ ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খালপাড় উচ্ছেদ প্রক্রিয়া থেকে কার্যত হাত তুলে নিচ্ছেন স্থানীয় প্রশাসনের তিন পুরপ্রধান। কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান, সিপিএমের তমাল দে বলেন, “সমস্যাটা যখন অন্যান্য পুরসভার ক্ষেত্রেও, তখন তারাও এগিয়ে আসুক। একক ভাবে কোনও ভূমিকা নেব না আমরা।” বরাহনগর পুরসভার তৃণমূল চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিক ও দক্ষিণ দমদমের তৃণমূল চেয়ারপার্সন অঞ্জনা রক্ষিতের দাবি, জবরদখলের সমস্যা তৈরি করেছে পূর্ববর্তী সরকার। তার জন্য কাজে সমস্যা হচ্ছে। আপাতত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার জন্য দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, খালঘেঁষা বাড়িগুলিকে শালবল্লার পাইলিং দিয়ে কিছুটা ছেড়ে পলি নিষ্কাশনের কাজ করা হবে।” উন্নয়নের কাজে ‘অবৈধ’ বসতি উচ্ছেদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান তাঁরা।
মেট্রোপলিটন ড্রেনেজ ডিভিশনের আশঙ্কা, এ ভাবে ছেড়ে ছেড়ে কাজ করতে গিয়ে খাল সংস্কার সার্বিক ভাবে হবে না। প্রায় ২৫ শতাংশ কাজ অসমাপ্ত থাকবে। কাজে নজরদারি করার কথা নোডাল অথরিটি কেএমডিএ-র। কেএমডিএ-র তরফে বলা হয়, “আমরা কেন্দ্রের কাছে যা রিপোর্ট দেওয়ার দেব। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।”
রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “বহু বছর বাদে এমন বড় করে বাগজোলার সংস্কার শুরু হল। অনেক কষ্টে এর জন্য টাকা আনতে হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিধায়ক, সাংসদ, সাধারণ মানুষ, মন্ত্রী থেকে সরকার সকলকেই এর গুরুত্ব বুঝে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে। আবেদনে ফল না হলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট জমা দেব। তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই হবে।”
জবরদখলের সমস্যার কারণে প্রশ্ন উঠেছে সংস্কারের পরবর্তী ফলাফল নিয়ে। খাল লাগোয়া বাড়িগুলির ধসে যাওয়া আটকাতে শালবল্লার পাইলিং করে খালের কিছুটা ছেড়ে ড্রেজিং করার সিদ্ধান্তে বিস্মিত নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তাঁর কথায়: “এটা সরকারের পক্ষ থেকে অবৈধ বাড়িগুলিকে মেনে নেওয়ার সামিল। এমনটা হলে ভবিষ্যতের জন্য একটা খুব বাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে। এতে ক্রমশ খাল সরু হয়ে বহনক্ষমতার সর্বনাশ হবে। ভেঙে পড়বে গোটা শহরের নিকাশি ব্যবস্থা।”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.