ব্যাগ গুছিয়ে...
কৃষ্ণসারের সন্ধানে
নৌকার ইঞ্জিনের একটানা ভটভট আওয়াজটা কানে বড় বাজছিল। কোনাকুনি ভাবে পুবের সূর্যটা চিলিকার জলে তখন রুপোলি রং গুলতে শুরু করেছে। ব্রাউন হেডেড পাল আর পানকৌড়ির দলটা পেটে হ্রদের জল লাগিয়ে পিঠে সূর্যের ওম নিচ্ছে মনের আনন্দে। মাঝিকে ইঞ্জিনটা বন্ধ করতে বলতেই কাছাকাছি নলবনের পাখিরালয় থেকে চিলিকার বারকুলের এই অঞ্চলে আসা ‘ওয়েট ল্যান্ড’-বিলাসী পাখিদের দিবারাত্রির গল্প বেশ স্পষ্ট হল। প্রসঙ্গত, নলবন পাখিরালয় এখন সাধারণ পর্যটকদের জন্য বন্ধ।
ওড়িশার বালুগাঁও স্টেশন থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরে চিলিকার একদম কিনারা ঘেঁষে ওড়িশা ট্যুরিজমের বারকুল পান্থনিবাসের প্রায় সব ঘর থেকেই চিলিকা হ্রদকে যেন ছোঁয়া যায়। রাতের ট্রেনে রওনা দিয়ে সকালে পান্থনিবাসে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ ঢুকিয়ে দিয়েই মুক্ত হ্রদে ভেসে পড়া। ‘মাছো লাগিব’ নৌকার একদম কাছাকাছি, ডিঙি নৌকাতে হাজির দু’জন মাছমারা। ডিঙির খোলে তখন কিলবিল করছে পেল্লাই ট্যাংরা, ভেটকি, আড়। ‘কিলো লেনে তিরিশ টঙ্কা লাগিব।’ ঠিক শুনছি তো। এমনিতে চিলিকার অপার সৌন্দর্যে চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। এ বার মাছের দাম শুনে যাকে বলে ছানাবড়া। কিলোতে ৮টা ট্যাংরা, সঙ্গে একটা ভেটকি প্রায় ফ্রি-তে নিয়ে যখন স্থলে উঠলাম তখন পেট আর মন দুটোই চনমনিয়ে উঠেছে।রুম বয়কে ম্যানেজ করে দুপুরে শুধু মাছ-ভাত। সে অপূর্ব স্বাদ হৃদয় ছুঁয়ে পেটকে শান্ত করল। খেতে খেতেই হোটেল-ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ হল। আমাদের গন্তব্য শুনে বললেন, ‘‘দেখবেন কী ভাবে চরে বেড়াচ্ছে দুষ্প্রাপ্য ব্ল্যাকবাক বা কৃষ্ণসার হরিণের দল।” তর সইছিল না। গেটের গোড়ায় গাড়ি এসে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি চেপে পড়লাম।
পূর্বঘাট পর্বতমালার কোলে ছবির মতো রাস্তা ধরে গাড়ি এগোল জেট গতিতে। প্রথমে মাঝে মাঝে গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল চিলিকার জলছবি। তার পরে শুধুই ছবির মতো গ্রাম আর ধানখেত। লালচে মাটির সঙ্গে সবুজের লুকোচুরি।
প্রায় ৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ‘আসকা’ যেতেই ঘণ্টাখানেক লাগল। আর কয়েক কিমি গেলেই ভেটনাই গ্রাম। ধানখেতের ধারের সাইনবোর্ডটা জানাচ্ছে আমরা গঞ্জাম জেলায় ভঞ্জনগরে আছি। হলুদ শুকনো খড়ের মাঠে রং ছড়িয়ে অপূর্ব রঙিন নীলকণ্ঠ পাখিটা সুরেলা শিসে জানাচ্ছে, আমরাও আছি। একদা এই গ্রামে ফসল ফলাতে কালঘাম ছুটত আদিবাসীদের। বৃষ্টির অভাবে খেতের ফসল ঝলসে যেত। সে প্রায় একশো বছর আগের কথা। হঠাৎ একদিন গ্রামের লোকেরা আবিষ্কার করলেন প্রায় ডজনখানেক কৃষ্ণসার বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। আর সে বার থেকেই লাগাতার বৃষ্টিতে খেতে সোনা ফলতে থাকে। গ্রামবাসীরা মনে করলেন ওই হরিণকুলই ঈশ্বরের দূত। ওদের লালন-পালন করতে থাকলেন তাঁরা। এই পরিচর্যায় কৃষ্ণসারের দল কয়েক যুগ পরে আজও বহাল তবিয়তে।
আচমকা গাড়ি গতি কমিয়ে পাকা সড়ক থেকে আবাদি মাঠে ঢুকে পড়ে।
“ওই দেখুন”, চালক বলেন। একেবারে সামনে শ’মিটার দূরত্বে ব্ল্যাকবাক। দম্পতি-সহ দূরে আরও কয়েকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী অপূর্ব তার রূপ, শিঙের কারুকার্য। পশু-পাখিদের জগতে পুরুষেরাই আকর্ষণীয়। এখানেও তার অন্যথা নেই। পড়ন্ত দুপুরের আলো কালো-সাদা রঙের পুরুষ হরিণটির গায়ে পড়ে দেখাচ্ছে রঙিন পেশিবহুল পেলবতা কাকে বলে। পাশে বাদামি রমণী কৃষ্ণসারটি রমণীয়, তবে তার পাশে ঈর্ষণীয় নয়। জঙ্গল নয়, ধানখেতের মধ্যে সার সার চরে বেড়াচ্ছে ভারতের অতি দুষ্প্রাপ্য ব্ল্যাকবাক বা কৃষ্ণসার। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ১নম্বর শিডিউলের অন্তর্গত এই প্রাণী এখানে বড় নিশ্চিন্ত। ২০১০-এ শেষ সুমারি অনুযায়ী সংখ্যায় তারা ২৩৯১, ভাবা যায়!
ছবি তোলার আগ্রহে হেঁটে একটু বেশি কাছে চলে গিয়েছিলাম এক জায়গায়। সচকিত ব্ল্যাকবাকরা শূন্যে ছুড়ে দিল শরীরটা, আকাশের দিকে মুখ করে। তার পরে তীব্র দৌড়, আবার আকাশ ছোঁয়া। সে এক অসাধারণ প্রতিযোগিতা যেন। শেষবেলায় পূর্বঘাট পর্বতমালার আরও পশ্চিমে ডুবন্ত সূর্যটা তখন আবির গুলছে।

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে চেন্নাই মেল, ফলকনামা বা যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসে বালুগাঁও স্টেশন।
স্টেশন থেকে অটো বা প্রাইভেট গাড়িতে চার কিমি বারকুল।
কোথায় থাকবেন
ওটিডিসি পান্থনিবাস ছাড়াও বারকুলে বেসরকারি হোটেল আছে।
কখন যাবেন
প্রচণ্ড গরম ছাড়া সব সময় যাওয়া যায়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.