ডেঙ্গির বিপদ নিয়ে শেষ পর্যন্ত টনক নড়ল রাজ্য সরকারের। মাসখানেক যাবৎ কলকাতা ও আশপাশে মশাবাহিত রোগটির দাপট চলার পরে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়ে এ বার সরকারি নির্দেশিকা জারি হবে।
এত দিন ধরে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর আর কলকাতা-বিধাননগর পুরসভা ডেঙ্গি সংক্রমণের ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন সরকারি সূত্রের দাবি, দু’দিন কলকাতার দু’টো হাসপাতাল ঘুরে এবং একটি হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। পাশাপাশি ডেঙ্গি সম্পর্কে মানুষের মনে যে যুগপৎ বিভ্রান্তি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা-ও অনুধাবন করেছেন।
তাই ডেঙ্গি প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সরকারি নির্দেশিকা প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন বলে সরকারি-সূত্রে বলা হয়েছে। ওই নির্দেশিকা মারফত আমজনতাকে জানিয়ে দেওয়া হবে, কোন ওষুধ খাওয়া উচিত, কোনটা নয়। ওষুধের সঙ্গে পথ্যই বা কী হওয়া দরকার, সে সম্পর্কেও সরকার মানুষকে পরামর্শ দেবে। রাজ্যবাসীর প্রতি এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন, “প্লিজ, দয়া করে এমন ওষুধ খাবেন না, যাতে উল্টো ফল হতে পারে। স্বাস্থ্য দফতরকে এ ব্যাপারে একটা প্রেসক্রিপশন করতে বলেছি।”
রাজ্যের মানুষের স্বার্থে স্বাস্থ্য দফতর কি এমন নির্দেশিকা আগেই জারি করতে পারত না?
দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস সরাসরি মন্তব্য করেননি। তবে তিনি শুধু বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ আসার পরেই আমরা ওষুধ-পথ্যের তালিকা বানিয়ে ওঁর অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি।” |
ডেঙ্গি সংক্রমণ প্রসঙ্গে মমতা এ দিন বলেন, “আজ সকালেই চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রের সঙ্গে কথা বলেছি। একশো জনের মধ্যে দু’-তিন জনের রক্তে ডেঙ্গির এমন জীবাণু মিশে যায়, যা মারাত্মক।” সুব্রতবাবুও বলেন, “বৃহস্পতিবার সকালে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ডেঙ্গি নিয়ে। উনি নানা তথ্য জেনেছেন। আমি ওঁকে ক্ল্যাসিকাল আর হেমারেজিক ডেঙ্গির পার্থক্য বুঝিয়েছি।” সুব্রতবাবুর দাবি, প্রতি একশো জনে তিন-চার জনের হেমারেজিক ডেঙ্গি হয়, সে ক্ষেত্রে রোগীর ‘শক সিনোড্রোম’ও হতে পারে। তাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। ডাক্তারেরা জানাচ্ছেন, ডেঙ্গি-ভাইরাসের সংক্রমণে যে হেতু শরীরে জলে টান পড়ে, তাই সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে নুন-চিনির জল খাওয়া উপকারী। এতে শরীরে জলের ভারসাম্য রক্ষা হয়।
এ দিকে মঙ্গলবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও ডেঙ্গি নিয়ে ‘আতঙ্ক না-ছড়ানোর’ আবেদন করেছেন চিকিৎসকমহল ও বিভিন্ন হাসপাতাল-নার্সিংহোমকে। মমতার বক্তব্য: যাঁদের ভর্তি করার দরকার নেই, অহেতুক তাঁদের ভর্তি করে যেন ত্রাস সৃষ্টি করা না-হয়। বস্তুত এ দিন এক বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে এ নিয়ে ‘সতর্ক’ও করে এসেছেন তিনি।
খিদিরপুরের ওই হাসপাতালটিতে এই মুহূর্তে ৬৮ জন ডেঙ্গি-রোগী ভর্তি। মুখ্যমন্ত্রী হাসপাতাল-কর্তাদের কাছে জানতে চান, কোন মাপকাঠি মেনে রোগী ভর্তি হচ্ছে? বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করানোয় রোগীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে কি না, তার খোঁজও নেন। সেই সঙ্গে জানান, রক্তে ডেঙ্গি সংক্রমণের চটজলদি পরীক্ষার জন্য যে বিশেষ ‘কিট’ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস (নাইসেড)-এর মাধ্যমে আনানো হচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও তা দেওয়া হবে। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে সেই ‘এনএস-১’ পরীক্ষার খরচ খানিকটা কমিয়ে আনার অনুরোধও জানিয়ে এসেছেন মমতা।
হাসপাতালের বক্তব্য কী? খিদিরপুরের বেসরকারি হাসপাতালটির সিইও রূপক বড়ুয়া বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরাও ওঁকে জানিয়েছি যে, আতঙ্ক তৈরির কোনও অভিপ্রায় আমাদের নেই। বরং ডেঙ্গি হলেই যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই, তা বোঝাতে আমরা ইতিমধ্যে রোগী ও বাড়ির লোকের কাউন্সেলিং শুরু করে দিয়েছি।”
তবে ডেঙ্গির চিকিৎসা-প্রতিরোধের সরকারি নির্দেশিকা জারি হওয়ার দিনই ডেঙ্গি মোকাবিলায় রাজ্যের ‘চরম অবহেলা ও গাফিলতি’র অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ-মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাটি করেছেন আইনজীবী বাসবী রায়চৌধুরী। আবেদনকারীর আর্জি, অবিলম্বে শুধুমাত্র ডেঙ্গি চিকিৎসার বিশেষ ক্লিনিক চালু করতে সরকারকে নির্দেশ দিক আদালত। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জেএন পটেল ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চে আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখনই কোর্টের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এর প্রেক্ষিতে আজ, শুক্রবারই মামলার শুনানি করতে আদালতকে আর্জি জানিয়েছিলেন সুব্রতবাবু। ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে, আজই শুনানি হবে। |