নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
চার মাস ধরে নিখোঁজ মা। তিন বছরের মেয়ে আর সাত বছরের ছেলেটির তাই একমাত্র ভরসা ছিলেন বাবা। সেই বাবার বিরুদ্ধেই উঠল অত্যাচারের অভিযোগ। কখনও বেল্ট-লাঠি দিয়ে মারধর, তো কখনও ছুরি দিয়ে হাত কেটে দেওয়া। শেষে গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছেলের হাত পুড়িয়ে দেওয়ার পরে মামার লিখিত অভিযোগ পেয়ে বাবাকে গ্রেফতার করল বালি থানার পুলিশ। বৃহস্পতিবার, হাওড়ার বেলুড় থেকে।
|
গুরপ্রীত। |
পুলিশ জানায়, বেলুড় এলাকায় জিটি রোডের ধারে একটি আবাসনের তিনতলার বাসিন্দা, পেশায় ব্যবসায়ী রঞ্জিত সিংহ সাইনির স্ত্রী সুরিন্দর কৌর চার মাস আগে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এই ঘটনার চার দিন পরেই বেলুড়ের একটি বন্ধ কারখানায় ছাইয়ের স্তূপ থেকে এক পুরুষ ও এক মহিলার পচাগলা দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তখন সুরিন্দরের ভাই মনজিৎ সিংহ পুলিশের কাছে দাবি করেন, ওই মহিলার দেহটি তাঁর দিদির। পুলিশ ডিএনএ পরীক্ষা করে। কিন্তু তার রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। তাই ওই মহিলার দেহ সুরিন্দরের কি না, তা প্রমাণিত হয়নি।
পুলিশ জানায়, চার মাস ধরে বাবার কাছেই ছিল ছেলে করণজিৎ সিংহ সাইনি ও মেয়ে গুরপ্রীত কৌর। শিশু দু’টির মামার বাড়ি ওই আবাসনেরই একতলায়। মামা মনজিৎ সিংহের অভিযোগ, প্রায় প্রতি দিনই কোনও কারণ ছাড়া করণজিৎ ও গুরপ্রীতকে বেধড়ক মারধর করতেন রঞ্জিত। বেল্ট, লাঠি দিয়ে পেটানো হত তাদের। কখনও কখনও সেই মারধরের মাত্রা আরও বাড়ত। অভিযোগ, কয়েক দিন আগেই ছুরি দিয়ে করণজিতের উপরে হামলা করেন তার বাবা। তাতে করণজিতের ডান হাতে আঘাত লাগে। মনজিৎ বলেন, “রোজই ওদের পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা আমাকে মারধরের কথা বলত। আমি কিছু বলতে গেলেই রঞ্জিত আজেবাজে কথাবার্তা বলত। কিন্তু গত মঙ্গলবারের ঘটনার পরেই সিদ্ধান্ত নিই, ভাগ্নে ও ভাগ্নিকে নিজের কাছে নিয়ে আসব।” তিনি জানান, তাঁর দিদির দেড় বছরের আর একটি ছেলে ছিল। তিনি নিখোঁজ হওয়ার ১৫ দিন আগে ওই বাচ্চাটিকে বুকে লাথি মারেন রঞ্জিত। তাতেই ও মারা যায় বলে অভিযোগ। |
হাতের ক্ষত দেখাচ্ছে করণজিৎ। |
বিষয়টি চাপার হলেও পরে জানাজানি হয়।
কী ঘটেছিল মঙ্গলবার? মনজিৎ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, ওই দিন ভোর চারটের সময়ে ছেলে ও মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে পড়তে বসতে বলেন রঞ্জিত। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ছাত্র করণজিৎ ও কে জি-র ছাত্রী গুরপ্রীত তাতে রাজি হয়নি। তখনই ইস্ত্রি গরম করে করণজিতের বাঁ হাতে ও কানের নীচে চেপে ধরেন তার বাবা। দাদাকে মার খেতে দেখে বোন বাঁচাতে এলে তাকেও দেওয়ালে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তার কপালে আঘাত লাগে। বুধবার বিকেলে জামাইবাবু রঞ্জিত ঘরে না থাকার সুযোগে তিনি শিশু দু’টিকে নিজের কাছে নিয়ে চলে আসেন। এর পরেই তিনি বিষয়টি জানান পরিচিত ব্যক্তি সুকান্ত মান, স্থানীয় বাসিন্দা বৈশাখী ভৌমিক এবং লীনা দাসকে। তাঁরাই মনজিৎকে থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরামর্শ দেন। বৃহস্পতিবার সকালে সুকান্তবাবুরাই শিশু দু’টি ও তাদের মামাকে নিয়ে বালি থানায় যান। ঘটনাটি শুনেই পুলিশ লিখিত অভিযোগ দায়ের করে বাচ্চা দু’টিকে জয়সোয়াল হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করায়। এর পরে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় লিলুয়া হোমে, জেলা শিশু কল্যাণ দফতরে। সেখান থেকে ছেলেটিকে পাঠানো হয় হাওড়ারই একটি বেসরকারি হোমে এবং মেয়েঠিকে রাখা হয় লিলুয়া হোমেই। রাতে রঞ্জিতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সঙ্গে তার এক ভাইকেও মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত বলে আটক করা হয়েছে।
এ দিন বিকেলে শিশু কল্যাণ দফতরের বেঞ্চে বসে করণজিৎ বলল, “পাপা আমাকে বলত, তোদের মেরে ফেলব। তার পরে আর একটা বিয়ে করব। রোজ মারত।” দাদার পাশে বসে খেলা করছিল ছোট্ট গুরপ্রীত। সে বলল, “আমরা কখনও কোনও দুষ্টুমি করতাম না।” |