অগ্নি দুর্ঘটনামাত্রেই বারণাবতের উপমা টানিয়া আনা হয়। যে শহরটিকে আধুনিক ভারতের বারণাবত বলিলে বিন্দুমাত্র অতিকথন হইবে না, তাহার নাম শিবকাশী। তামিলনাড়ুর এই শহরটিকে দেশের ‘বারুদ রাজধানী’ বলা চলে। দেশে মোট যত বাজি তৈরি হয়, তাহার নব্বই শতাংশই হয় এই শহরে। দেশলাই উৎপাদনের ক্ষেত্রেও অনুপাতটি অভিন্ন। গত বৎসর শুধুমাত্র বাজি বেচিয়া এই শহর ২,০০০ কোটি টাকারও অধিক আয় করিয়াছে। অর্থাৎ, এই শহরের অর্থনীতি আক্ষরিক অর্থেই বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়াইয়া আছে। বারুদ যখন, চূড়ান্ত সতর্ক না থাকিলে বিস্ফোরণ না ঘটাই আশ্চর্যের। গত ১২ বৎসরের একটি হিসাব পাওয়া গিয়াছে শিবকাশীতে বাজি কারখানার দুর্ঘটনায় মোট ২৩৭ জনের মৃত্যু ঘটিয়াছে। আহত দুই শতাধিক। সাম্প্রতিকতম দুর্ঘটনাটি অবশ্য এই হিসাবের বাহিরে। এবং, এই দুর্ঘটনাগুলির বেশির ভাগই ঘটিয়াছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি মাপের কারখানায়, বিশেষত দীপাবলির জন্য বাজির চাহিদা বাড়িবার পর। সত্য, অগ্নি যাহাকে দগ্ধ করিতে পারে না, তাহার নাম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
প্রথম প্রশ্ন, বাজি তৈরির ন্যায় বিপজ্জনক কাজ কি আদৌ আইনত সিদ্ধ হওয়া উচিত? না কি, এই শিল্পটিকে নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়াই বিধেয়? প্রশ্নটি বিপদের মাপের নহে, সেই বিপদের ম্যানেজমেন্টের। অর্থাৎ, পদ্ধতিগত বিপদই হউক বা দুর্ঘটনাজনিত বিপদ কোনও ক্ষেত্রে বিপদের সম্ভাবনা থাকিলে তাহাকে কী ভাবে ঠেকানো হইবে, তাহা দ্বার্থহীন ভাবে জানাই প্রকৃত প্রয়োজন। ভারতে এই জিনিসটির বড়ই অভাব। ফলে, বাজির ন্যায় অতি বিপজ্জনক বস্তুর ক্ষেত্রেও নিরাপত্তার ফাঁক বড় প্রকট হইয়া থাকে। তাহাতেই নিষিদ্ধ করিবার প্রশ্ন উঠে। কিন্তু, নিষেধাজ্ঞা সমাধান নহে। বস্তুত, নিষিদ্ধ হইলে ব্যবসাটি আইনের নাগালের আরও বাহিরে চলিয়া যাইবে, ব্যবসায়ীরা আরও ঝুঁকি লইবেন, আরও বড় বিপদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হইবে। সেই পরিস্থিতি কাম্য নহে। বিশ্বের বহু দেশেই বাজি তৈরি হয়। কিন্তু ভারতের ন্যায় দুর্ঘটনা ঘটে না। কারণ, সেই দেশগুলিতে নিরাপত্তাবিধি অতি স্পষ্ট এবং কঠোর।
ভারতেও এই কঠোর নিরাপত্তাবিধিই প্রয়োজন। শিবকাশীতে যে বাজির কারখানায় বিস্ফোরণে এতগুলি প্রাণহানি হইল, সেই কারখানাটিতে কার্যত অগ্নি-নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। অধিকাংশ ছোট কারখানায় থাকেও না। অধিক লাভের চেষ্টায় মালিকরা অদক্ষ শ্রমিকদের কম মজুরিতে নিয়োগ করেন, একই ঘরে বহুবিধ বাজি প্রস্তুত করিতে বাধ্য করেন। কারখানার ভিতরেই প্রভূত পরিমাণ বারুদ, বাজি জমা হইয়া থাকে। এখন বাজারে রকম-বেরকমের বাজির চাহিদা বাড়িয়াছে। ফলে, বিভিন্ন রাসায়নিক লইয়া যথেচ্ছ পরীক্ষানিরীক্ষাও চলিতেছে। সেই কাজের জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন, শিবকাশীর কারখানাগুলিতে তাহা আশা করাও বাতুলতা। দুর্ঘটনার জন্য এত রকম আমন্ত্রণপত্রের ব্যবস্থা থাকিলে দুর্ঘটনা যে ঘটিবে, তাহা আর আশ্চর্যের কী! প্রশাসনের কাজ, এই অনিয়মগুলি কঠোর হাতে বন্ধ করা। কড়া নজরদারি প্রয়োজন। যে কারখানা নিয়মের বিন্দুমাত্র অন্যথা করিবে, তাহার লাইসেন্স তো কাড়িয়া লইতেই হইবে, মালিকের কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থাও প্রয়োজন। দুর্ঘটনা ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করিলে চলিবে না, প্রশাসনকে পূর্বাহ্ণেই তৎপর হইতে হইবে। আইনের শাসনকে পাশ কাটাইয়া যাওয়ার চেষ্টা ভারতীয়দের মজ্জাগত। বাজির ন্যায় বিপজ্জনক শিল্পে তাহা যাহাতে কোনও মতেই সম্ভব না হয়, তাহা নিশ্চিত না করিলে আরও বহু দুর্ঘটনার খবর পাইতে হইবে বইকী। |