খরস্রোতা তিস্তার বাঁক ছুঁয়েছে ঘন সবুজ জঙ্গল। নদী-বাঁধের কিনারে এসে তাকালে স্পষ্ট হয়ে উঠছে দূরের হিমালয়। শহর শিলিগুড়ি থেকে যৎসামান্য দুরত্বে এমন নিসর্গ এমনিতে বিরল নয়।
কিন্তু পর্যটনের প্রসারে স্রেফ প্রকৃতির এই ‘সম্পদ’ই যথেষ্ট নয়। ‘খোদার উপরে খোদকারি’রও যে খানিকটা দরকার পড়ে, এই সারসত্যটুকু রাজ্য পর্যটন দফতর এত দিনে বুঝতে পারছে। তাই তিস্তা ব্যারাজের তীরে ২০৭ একর তেকোনা এলাকা নিয়ে গড়ে উঠছে নতুন পর্যটনকেন্দ্র গজলডোবা। প্রকৃতির উপহার ছাড়াও সেখানে সেজে উঠছে গল্ফকোর্স, আয়ুর্বেদিক স্পা, লেক রিসর্ট-সহ অভিজাত বিনোদনের রকমারি উপকরণ।
পর্যটনে স্রেফ প্রকৃতিদত্ত বা ইতিহাসগত ‘অ্যাডভান্টেজ’টাই যে শেষ কথা নয়, পর্যটন-বিশেষজ্ঞেরা তা অনেক আগেই বুঝেছেন। এমনকী, দ্রষ্টব্য স্থান ‘সুগম’ করতে শুধু রাস্তাঘাট উন্নত করলেই হয় না, আরও উৎকর্ষ যোগের দরকার রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দেশের কয়েকটি রাজ্যেও বিভিন্ন ‘টুরিস্ট স্পট’-এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে জমে উঠেছে গল্ফ-ট্যুরিজম বা নানা জাতীয় বিনোদন। ব্যতিক্রম ছিল পশ্চিমবঙ্গ। পর্যটন নিয়ে সৃজনশীলতার দৈন্যে এ রাজ্য বরাবরই কার্যত পিছিয়ে থেকেছে বলে অভিযোগ।
তবে দীর্ঘলালিত এই ‘জড়তা’ ভাঙার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে। ঠিক যেমন প্রকৃতির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আধুনিক বিনোদনের সম্ভারে সেজে উঠেছে সিঙ্গাপুর-হংকং-তাইল্যান্ড কিংবা এ দেশের কেরল, সেই পথে এ বার হাঁটছে ডুয়ার্সের গজলডোবা। যার এক দিকে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল। অন্য দু’দিকে তিস্তা ব্যারাজ ও তিস্তা খাল। ব্যারাজের ধারে দাঁড়ালে হিমালয় দৃশ্যমান। ঠিক হয়েছে, জঙ্গলের গা ঘেঁষেই থাকবে বিনোদনের প্রাচুর্য। সুদৃশ্য গল্ফকোর্স, আয়ুর্বেদিক স্পা, বাগিচা, হ্রদ-রিসর্ট, বটানিক্যাল গার্ডেন থেকে শুরু করে সুউচ্চ মিনার-রেস্তোরাঁ, দেশজ সংস্কৃতির কেন্দ্র ও ছোটদের আমোদের পার্ক। |
অনেকের কাছে এখনও অজানা গজলডোবাকে পশ্চিমবঙ্গের নয়া পর্যটন-ভাবনার দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার সামগ্রিক পরিকল্পনাটিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ‘আইএলএফ অ্যান্ড এস’ নাম এক সংস্থা। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট সুদীপ দত্ত বলেন, “সব ধরনের পর্যটকদের পছন্দ-অপছন্দের দিকগুলো ভেবে কাজটা হচ্ছে।” জল-জঙ্গল-পাহাড় ঘেরা এলাকার কিছুটা জুড়ে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী শিবির। বাকি ২০৭ একরে গড়ে উঠবে পর্যটনকেন্দ্র। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল এবং মূল পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ৭৫ একর এলাকা জুড়ে তৈরি হবে ‘বাফার জোন’ এবং গল্ফ কোর্স। বাকি অংশে বিনোদনের অনান্য উপকরণ। পর্যটকদের থাকার জন্য ‘তিন তারা’ থেকে ‘পাঁচ তারা’ আয়োজন। শিশু-বৃদ্ধদের কথা ভেবেও কিছু বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রস্তাবিত পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে ১৮ একরের একটি জলাশয়ও থাকছে। তাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হবে লেক রিসর্ট ও টাওয়ার রেস্তোরাঁ। সুদীপবাবুর কথায়, “শীতকালে গজলডোবায় অনেক পরিযায়ী পাখি আসে। তাই বার্ড ওয়াচ টাওয়ার রাখা হবে। সেখান থেকে পাহাড়ও দেখা যাবে।” পরিবেশ নির্মল রাখতে পর্যটনকেন্দ্রের অন্দরে শুধু ব্যাটারিচালিত গাড়ি চলবে।
ওখানে যাওয়ার রুট কী?
রাজ্যের পর্যটন-সচিব বিক্রম সেন বলেন, “শিলিগুড়ি থেকে গজলডোবা যেতে যে পথে সবচেয়ে কম সময় লাগে, সেখানে একটি রক্ষীবিহীন লেভেলক্রসিং আছে। রেল দফতরকে তা জানিয়েছি। রাস্তাটা ঠিক হয়ে গেলে শিলিগুড়ি থেকে আধ ঘণ্টার বেশি লাগবে না।” কিন্তু গজলডোবায় পর্যটনের এলাকাটা তো তুলনায় নিচু জমিতে। এতে অসুবিধে হবে না?
বিক্রমবাবুর আশ্বাস, “চার দিকে জলাশয় আর নদী থাকায় নিকাশির সমস্যা হবে না। ইতিমধ্যে জনস্বাস্থ্য কারিগরি ও সেচ দফতরের সঙ্গে কথা বলেছি।”
গজলডোবাকে ঘিরে প্রাথমিক পরিকল্পনার রূপরেখা অবশ্য যথেষ্ট উৎসাহ সঞ্চার করছে। পর্যটন দফতর-সূত্রের দাবি, ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি প্রায় কুড়িটি সংস্থা ওই তল্লাটে বিনিয়োগে উৎসাহ প্রকাশ করেছে। সচিব জানাচ্ছেন, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরেই পর্যটনকেন্দ্র গড়ার কাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। |