ভেসে গেল এক শিশু
দুই ছেলে নিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ মায়ের, বাঁচালেন মাঝি
কোলে দেড় বছরের ছেলে। তিন বছরের বড় ছেলে ধরে ছিল হাত।
নৌকায় ভিড় ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল টিপটিপ করে।
হঠাৎই দুই ছেলেকে নিয়ে নৌকা থেকে বর্ষার ভরা মাঝগঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন তরুণী। চমকে চিৎকার করে উঠলেন যাত্রীরা। মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে পড়লেন মাঝি। হাবুডুবু খেতে থাকা মা আর বড় ছেলেকে টেনে তুললেন নৌকায়। বছর দেড়েকের বাচ্চাটি ভেসে গেল।
বৃহস্পতিবার বিকেলে নদিয়ার কালীগঞ্জ থেকে বর্ধমানের কাটোয়ার দিকে আসা একটি নৌকোয় এই ঘটনা ঘটে যায়। জলে ঝাঁপ দিয়েও বেঁচে যাওয়া তরুণী পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁর নাম পবিত্রা ঘোষ। মুর্শিদাবাদে বেলডাঙার আন্দিকন গ্রামে তাঁর বাপের বাড়ি। শ্বশুরবাড়ি কালীগঞ্জে মাটিয়ারি-হিজুলি মোড় রাস্তার পাশে বড় আটাকি গ্রামে। তাঁর অভিযোগ, বেশ কিছু দিন ধরে শাশুড়ি তাঁর উপরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছিলেন। তাঁর স্বামী রাখহরি ঘোষও মায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেন না। সে কারণে দুই ছেলে রণজিৎ ও রাজকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন বলেও তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন।
বড় ছেলের সঙ্গে পবিত্রা।
কাটোয়া থানায় বড় ছেলে রণজিৎকে কোলে নিয়ে বসে পবিত্রা অভিযোগ করেন, “এ দিন সকালে শাশুড়ি ফের অত্যাচার করে। স্বামীকে বলি, এ বার বাড়ি ছেড়ে পালাব। ও আমায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলে।” এর পরেই তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে তিনি বল্লভপাড়া গ্রামে যান। সেখান থেকে কাটোয়ার নৌকা ছাড়ে। পবিত্রার কথায়, “আমাদের গ্রামের অনেকে কাটোয়ায় কাজ করতে যায়। আমিও ওখানে গিয়ে কাজ খুঁজে নেব ভেবে নৌকায় উঠি।”
কিন্তু নৌকা মাঝগঙ্গায় পৌঁছতেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। বারবার মনে পড়তে থাকে, এমনকী স্বামীও পবিত্রাকে চলে যেতে বলেছেন। “আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। খালি মনে হচ্ছিল, আর বেঁচে কী লাভ? প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। সহ্য করতে না পারে দুই ছেলেকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই।” বাকি যাত্রীরা প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা জানান, ঝাঁপ দেওয়ার পরেই ছোট ছেলেটি মায়ের কোল থেকে ছিটকে যায়। কিন্তু বড় ছেলের হাত পবিত্রা ছাড়েননি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূর্য হালদার, মহতাব হোসেনরা জানান, “ওরা ঝাঁপ দিতেই মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে নেন। এক মাঝি জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন।” সেই মাঝি, গৌরাঙ্গ রাজোয়াড় প্রথমে রণজিৎকে ধরে নৌকায় তুলে দেন। তত ক্ষণে কাছাকাছি থাকা আর একটি নৌকা থেকে তিন-চার জন যাত্রীও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। নৌকা ঠেলার লগা বাড়িয়ে দিতে পবিত্রা তা আঁকড়ে ধরেন। তাঁকেও নৌকায় তুলে দেন গৌরাঙ্গবাবু। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “ওই মাঝির জন্যই মা-ছেলের প্রাণ বেঁচেছে। দেড় বছরের শিশুটিকে খোঁজার চেষ্টা চলছে।”
মাঝি গৌরাঙ্গ রাজোয়াড়।
খবর পেয়ে কার্যত হতবাক হয়ে গিয়েছেন পবিত্রার স্বামী রাখহরি। তাঁর কথায়, “সমস্ত সংসারেই ছোটখাটো অশান্তি লেগে থাকে। তার জন্য পবিত্রা এ রকম কিছু করে ফেলতে পারে, ভাবতেই পারিনি। মাঝির জন্য অন্তত দু’জন বেঁচেছে।” তাঁর বাড়ি বল্লভপাড়া গ্রামের খাসপাড়ায়। বাইশ বছর ধরে নৌকা চালাচ্ছেন। তাঁর সহকর্মীদের কথায়, “প্রায়ই নানা ব্যাপার নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে আমাদের বচসা হয়। এ বার বোধহয় ওঁরা বুঝবেন, আমরা অমানুষ নই।” গৌরাঙ্গবাবুর স্ত্রী তুলসীদেবী বলেন, “নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ও মা-ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছে শুনে গর্ব হচ্ছে।”
কিন্তু যাঁর নামে এত প্রশংসা, তাঁর মন ভাল নেই। বিষণ্ণ মুখে গৌরাঙ্গবাবু বলেন, “ছোট্ট বাচ্চাটা ভেসে গেল। সেটাই ভুলতে পারছি না।”

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.