পুরাকালে হনুমানের লেজ থেকেই আগুন লেগেছিল লঙ্কায়। ডট কম যুগের হনুমান বরফের দেশে গিয়ে সেঁধোল!
সুমেরু মুলুকে বাংলা ছবি ‘হনুমান ডট কম’-এর শ্যুটিং আক্ষরিক অর্থেই ‘জমে’ গিয়েছে!
এখনই দিনের বেলা সাত ডিগ্রি তাপমাত্রা। কিন্তু সেটাও তেমন কিছু নয়। শীত কালে ভারতের অনেক শহরেই তাপমাত্রা এর চেয়ে নীচে থাকে। আসল ব্যাপারটা হল, খাস সুমেরু থেকে বয়ে আসা হাড় হিম করা হাওয়া। এসইউভি গাড়িগুলো পর্যন্ত খেলনার মতো কাঁপছে। ক্যামেরা বিভাগে মোটে তিন জন। তাঁদের সঙ্গেই ঠকঠক করে কাঁপছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কখনও সুমেরু সাগরের সামনে দাঁড়িয়ে শট দিচ্ছেন। কখনও বা লোকেশন বদলের সময়ে কলাকুশলীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্যুটিংয়ের যন্ত্রপাতি সরাচ্ছেন।
সবেতেই তিনি। কেন? প্রসেনজিৎ মুক্ত কণ্ঠে বলছেন, “আইসল্যান্ড যে একটা অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ জায়গা, এটা সকলেই জানে। সুমেরু হাওয়ার দাপটে ভারী ওজনের গাড়ি পর্যন্ত দুলে ওঠে। আমি আসলে এই শ্যুটিংয়ের অভাবনীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে মনেপ্রাণে জড়িয়ে পড়েছি!” |
বরফ রাজ্যে বাঙালি। আইসল্যান্ডে ‘হনুমান ডট কম’ ছবির শ্যুটিংয়ে প্রসেনজিৎ। নিজস্ব চিত্র |
নমিত বাজোরিয়ার প্রযোজনায় গত পনেরো দিন ধরে ‘হনুমান ডট কম’-এর শ্যুটিং চলছে আইসল্যান্ডে। হিমশীতল সুমেরুবৃত্তের এত কাছে বাংলা সিনেমার পটভূমি! ঐতিহাসিক তো বটেই, এক কথায় অদ্বিতীয়ও। পিয়ার্স ব্রসনান, হাল বেরি, ক্রিশ্চিয়ান বেল, মাইকেল কেইন, রাসেল ক্রো-র মতো হলিউড তারকারা যেখানে কাজ করে গিয়েছেন, সেখানেই এ বার পা রেখেছে টলিউড। “পুরো ব্যাপারটার জন্য বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি অসম্ভব গর্বিত,” বলছেন প্রসেনজিৎ। একমত পরিচালক গৌরব পান্ডেও। এর আগে মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে ‘শুকনো লঙ্কা’ ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন তিনি। গৌরব বললেন, “আইসল্যান্ডে বেশির ভাগ হলিউডি ছবিরই শ্যুটিং হয়। কারণ তাদের খরচ করার ক্ষমতাটা অনেক বেশি।”
ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ব্যাটম্যান বিগিন্স’-এর শ্যুটিং হয়েছিল আইসল্যান্ডে। জেমস বন্ড সিরিজের ‘ডাই অ্যানাদার ডে’-র শ্যুটিং আইসল্যান্ডে। হয়েছে ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ’। ডারেন অ্যারনফস্কি তাঁর নতুন ছবি ‘নোয়া’র শ্যুটিং করে গিয়েছেন এই জুলাই মাসেই। রাসেল ক্রো ছিলেন নাম ভূমিকায়। অন্য একটি ছবির জন্য লোকেশন দেখে গিয়েছেন টম ক্রুজও। “কিন্তু বাংলা ছবির পক্ষে এত দূর আসাটা একদম অভাবনীয়। এ রকম একটা পদক্ষেপ করতে গেলে আলাদা দম চাই,” সরাসরি বললেন গৌরব।
তবে কি আইসল্যান্ডে শ্যুটিং করতে পারাটাই আত্মতৃপ্তি? মোটেই নয়, প্রসেনজিৎ সে কথা বলছেন না। ওঁর মতে, “আইসল্যান্ডে শ্যুটিং আসলে একটা রূপকমাত্র। এতে প্রমাণ হয় যে আমরা ক্রমশ বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানে পৌঁছতে শুরু করেছি!” কী ধরনের মানের কথা বলছেন তিনি? আবেগঘন গলায় ‘বুম্বা’র উত্তর, “আমি চাই এই ছবিটা ‘অটোগ্রাফ’-এর মতো সফল হোক আর ‘গান্ডু’র মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাক!” এই সেতুবন্ধনে ‘হনুমান’ সফল হবে কি না, সেটা সময় বলবে! কিন্তু আইসল্যান্ডের মতো লোকেশন নিয়ে ভ্রমণপিপাসু বাঙালির যে একটা বাড়তি আগ্রহ থাকবে সে বিষয়ে গোটা ইউনটিই আশাবাদী।
সুমেরু সাগর আর উত্তর অতলান্তিকের সংযোগস্থলে দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ড। বিশ্বের অন্যতম জনবিরল দেশ। মনে রাখা যাক, আইসল্যান্ডের রিকিয়াভিকই বিশ্বের ‘উত্তরতম’ রাজধানী। আর মাত্র দু’ডিগ্রি উত্তরে গেলেই সটান সুমেরুবৃত্ত! বিশ শতকের গোড়াতেও সামান্য চাষবাস আর ধীবরবৃত্তির উপরে নির্ভরশীল আইসল্যান্ড বেশ গরিবই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্শাল পরিকল্পনার দৌলতে শুরু হল মৎস্যভিত্তিক শিল্পায়ন। নব্বইয়ের দশকে পৌঁছে আইসল্যান্ড হয়ে উঠল বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটা।
তার আগেই অবশ্য বেশ কয়েক বার সংবাদ জগতের শিরোনামে উঠে এসেছিল রিকিয়াভিক। ১৯৭২ সালে সোভিয়েত রাশিয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা লড়াইয়ের আবহে দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়নের আসরে দুই মহারথী ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকি পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন আইসল্যান্ডের রাজধানীতেই। বিশ্ব দাবায় সোভিয়েত রাশিয়ার চব্বিশ বছরের টানা একাধিপত্য ভেঙে সে বার জয়ী হয়েছিলেন ববি ফিশার। সম্পর্কের বরফ গলাতে ১৯৮৬ সালে এই বরফের দেশেই বৈঠক করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিখাইল গর্বাচেভ।
আর সিনেমা? আইসল্যান্ডে পনেরোটা সিনেমা সংস্থা আছে এই মুহূর্তে। এ দেশের তৈরি ছবি দু’দশক আগেই সেরা বিদেশি ছবির জন্য অস্কার দৌড়ে পৌঁছে গিয়েছে। এ দেশের অভিনেত্রীরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেছেন। তার মধ্যে আন্দ্রেই তারকভস্কি-র ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’-ও আছে, আবার ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ’-এর মতো ছবিও আছে। তবে টলিউডের মতো একটি আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা গিয়ে আইসল্যান্ডের মতো জায়গায় শ্যুটিং করার আগ্রহ দেখাচ্ছে দেখে, আইসল্যান্ডের লোকজনও একাধারে অবাক এবং অভিভূত। ছবির কার্যনির্বাহী প্রযোজক শিবাশিস শেঠ এখানে আছেন গত এক মাস ধরে। সব সময় ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। রিকিয়াভিকের মতো জায়গাকে লোকেশন হিসেবে বাছা! সেখানে পুরো টিম নিয়ে এসে নিখুঁত ভাবে শ্যুটিং করা ঝক্কি অনেক! প্রত্যেকেই জামাকাপড়ের তলায় পরে আছেন হটপ্যাড। এই ঠান্ডায় কিডনিকে রক্ষা করতে হবে তো! প্রসেনজিৎও মানছেন, এর আগে এমন প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে কখনও শ্যুটিং করেননি। শিবাশিস বলছেন, “সব দিকটা খুব ভাল করে ম্যানেজ করতে হবে। কারণ আইসল্যান্ড খুব খরচসাপেক্ষ দেশ। আর আমরা কিছু জানিও না এই দেশটার সম্বন্ধে।”
বাস্তবিকই আইসল্যান্ডে না-এলে বোঝা যায় না, কতটা কম জানি এই দেশটা সম্বন্ধে। বিমানবন্দর থেকে পা বাইরে রাখলেই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের রুক্ষতা আর কাঠিন্য সজোরে শরীরে এসে ঝাপ্টা মারে। সবুজের কোনও চিহ্ন নেই বললেই চলে। আগ্নেয়গিরিপ্রবণ অঞ্চল বলে চারিদিকে পথের ধারে ধারে অজস্র উষ্ণ প্রস্রবণ। দু’বছর আগেই এই আইসল্যান্ডেই জেগে উঠেছিল আগ্নেয়গিরি। সেই আগুনের ছাই আকাশে দলা পাকিয়ে গোটা উত্তর ইউরোপের বিমান চলাচল লাটে তুলে দিতে বসেছিল।
এ হেন আইসল্যান্ডে লালমোহনবাবুর গোয়েন্দা প্রখর রুদ্রও পা দেয়নি! টলিউড কিন্তু পৌঁছে গেল!
গোড়াতেই যে লিখলাম, শ্যুটিংটা কিন্তু জমে গিয়েছে! |