বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ শুধুই ২৫শে বৈশাখ আর ২২শে শ্রাবণ”এই ছক ভেঙে দিয়েছেন একজন। উত্তরবঙ্গে চলছে তাঁর লড়াই মজলিশ। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও, টিকিট বাতিল করেনি যে মেয়েসেই মেয়ে মায়ের ভালবাসায় প্রাণ দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ফাইনাল পরীক্ষা দিতে উঠে বসলেন দার্জিলিং মেলে। মৃত্যুকে “তঁহু মম শ্যাম সমান” যিনি ভাবেন, তাঁরা তো বীতশোক, আনন্দের পূজারী। আশ্চর্য রবিপ্রেম। ঘরে ঠাকুরের চাইতেও রবিঠাকুরের সংখ্যা বেশি। স্কুলে গতানুগতিক ছকভাঙা স্টাইলে পড়াল বাংলা। তাই তো লাস্ট বেঞ্চ থেকে ফাস্ট বেঞ্চের সবার কাছে তিনি মণিদীপাদি। আনমনে খাঁকির দেশে বকুল কুড়িয়েছেন ছাত্রীদের সঙ্গে। শাপমোচন থেকে চিত্রাঙ্গদায় ছাত্রীদের রবিঠাকুর চিনিয়ে চলেছেন এই দিদিমণি। রবিলেখা অনুবাদ হয়েছে বহু, আর তাই পড়ানোর মতোই ছকভাঙা দিদিমণির অন্য ভাবনা। |
সাদরী ভাষায় রবিগান দিয়ে যে যাত্রার শুরু, আজ সে ভাবনাই জন্ম দিচ্ছে নতুন রবিরসাদরী ভাষায় ভাষায় চিত্রাঙ্গদাঅনন্য, অনুপম। প্রান্তিক মানুষের কাছে ঠাকুরের গান পৌঁছে দেবার হরকরা। মনের মানুষ কাছে এলে তাঁর ডাকনাম বদলে যায় মণিদীপার কণ্ঠে। তাই তো গলার অপারেশনের পরও তাঁর আশ্রয় রবিতে। ম্যাসেজ সেন্ট হোলো “এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর”। উত্তরের বিচ্ছিন্নতাবাদে যখন আগুন দিয়েছে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, ডুয়ার্সের সবুজে রুখে দাঁড়ায় অবরোধতখনই মণিদীপার এই ভাবনা আলোড়ন তুলেছে রাজ্যময়। রবি ঠাকুরের ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ পর্বের সূচনা যদি হয় রাখি, তবে এই রবিপ্রেমিকের অনুবাদী গান ও থামিয়ে দিতে পারে উত্তরের সাম্প্রতিক অস্থিরতা। একশো পঞ্চাশ পেরিয়েও সুপারহিট রবি গানে একা আমি বহু হবার প্রত্যয়েই মণিদীপার এই দুর্গম অভিযান। অন্ধকার কুঁড়তে সাদরী শিখছেন ব্যতিক্রমী শিক্ষিকা। প্রবল ঝড়েও আগলে রাখছেন অনুবাদের পাতা। এ স্রোতে ভাসার অধিকারকে আরও মর্যাদা দিতে পাশে এলেন অলোকানন্দা রায়, অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। সমাজের প্রান্তিক মানুষকে টেনে তুলে রবির আলোয় উদ্ভাসিত করার পরও তাঁর কিছু কাজ বাকি থেকে গিয়েছিল। আর সেই মুক্তধারার মতোই জীবনের জয়গান গাইতে বহুদিন ধরেই তাঁর এই সাদরী গীতিনাট্যে মঞ্চে এসেছেন অন্যধারার পুরুষরা। ওষ্ঠরঞ্জনী, পনিটেল, আইলাইনার যাদের ব্রাত্য করেছে, মল থেকে হল ঘর যাদের নিয়ে হুইজপারডসেই সব মানুষদেরকে মঞ্চের রবিতর্পণে আলোর দিশা দেখালেন দিদিমণি। অলোকানন্দার নাইজেল, আর মণিদীপার বাদশাদুই স্রোত মিলিয়ে দিয়েছে মুক্তধারা। নৃত্যের তালে উড়ে গেছে অপমানের ঘুড়ি, উড়তে উড়তে একদিন আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলবে। তাই তো বাদশাদের ছেড়ে দেওয়া অবজ্ঞার চিলগুলো আজ মঞ্চে গ্রহ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সৌজন্যে মণিদীপাদি। আর সেই বাঁচার মঞ্চই আরও মজবুত হল ১৯ অগস্ট শিশিরমঞ্চে। সাদরী ভাষায় রবিগানে মিশে গেল অন্যধারার পুরুষ-নারী সকলে। মেকআপ ধুয়ে ফেলার পরও যাদের চিনতে মঞ্চে উঠে এলেন অলোকানন্দা রায়বিশ্ব যাদের কাছে কারাগার। প্রেমই তাদের কাছে মুক্তিউত্তর দক্ষিণের মুক্তধারায় ওদের মুক্তি রবির আলোয়।
|
ছবি ও লেখা সন্দীপন নন্দী। বালুরঘাট। দক্ষিণ দিনাজপুর
|
রাজ আমলের শিবতীর্থ খামার সিতাই শিবমন্দির |
কোচবিহার জেলার সিতাই ব্লকের খামার সিতাইয়ে রয়েছে প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন শিবমন্দির। প্রভাস চন্দ্র সিংহ শাস্ত্রীয় লেখা “সূর্য বংশানুক্রম রাজবংশ ক্ষত্রীয়” এই বইয়ে উল্লেখ আছে, মহারাজ প্রাণনারায়ণ ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ মোট ৩৯ বছর কোচবিহারে রাজত্ব করেন। ওনার এই রাজত্বকালে প্রায় একই সময় বালেশ্বর ও খামার সিতাই শিবমন্দির নির্মিত হয় বলে কথিত। খামার সিতাই শিবমন্দির কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত। মাঝে বেশ কয়েক বছর মন্দির পরিচালন সমিতির সঙ্গে ট্রাস্টের যোগাযোগের অভাবে মন্দিরের জন্য বরাদ্দ অনুদান বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৭ সালে কতিপয় উদ্যোগী লোক ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় আবার মন্দিরটি কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্টের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটে। গত পাঁচ বছর যাবৎ ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশী উপলক্ষ করে পনেরো দিনব্যাপী মেলা বসে। মেলা বলতে জিনিসপত্র কেনাবেচা, সার্কাস, নাগরদোলা এই নয়। মেলা কেন্দ্র করে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পত্রিকা প্রকাশ, বিভিন্ন পালা গান অনুষ্ঠিত হয়। এক কথায় মেলা কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের উৎসবে মাতে সিতাইবাসী।
|
তীর্থঙ্কর মণ্ডল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মোড়। কোচবিহার
|
অতি সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্রতম জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতির আঁতুরঘর অতিপ্রাচীন গ্রাম জগন্নাথবাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লোকসংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ কেন্দ্র ‘জগন্নাথ বাটি কৃষ্টি কলা কেন্দ্র’ এখানে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আত্মিকে যেমন পল্লিগীতি, লোকগীতি, পালাকীর্তন, লক্ষ্মীমঙ্গলা, চণ্ডীমঙ্গলা, নৃত্য ও নাট্য চর্চা ও সংরক্ষণে কর্মসূচি গৃহীত হচ্ছে। দু’দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবে কারা মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী ‘কৃষ্টি দর্পণ’ নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে স্বল্পব্যয়ে আবৃত্তি-অঙ্কন-নাচ শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি আগামী প্রজন্ম সাংস্কৃতিচর্চায় সমৃদ্ধ হতে পারে সে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর কেন্দ্র। ছোটদের অভিনয় শেখাতে নাট্য অ্যাকাডেমি গড়া হয়েছে। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বকে এনে অভিনয় শেখানোর পরিকল্পনা আছে বলে জানান কেন্দ্রের অন্যতম কর্ণধার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার, প্রেমলাল কর্মকার ও পরেশ চন্দ্র দাস।
|
রাজীবকুমার দাস। জগন্নাথবাটি। দক্ষিণ দিনাজপুর
|