সতর্ক থাকুন। তবে আতঙ্ক ছড়াবেন না।
রাজ্য জুড়ে ডেঙ্গি-আতঙ্কের আবহে মঙ্গলবার এই বার্তাই দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি মহাকরণে দাঁড়িয়ে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে এ বছরের ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’।
মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দাবি, চলতি বছর এই রাজ্যে ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা তিন জনের বেশি নয়। অন্য দিকে তামিলনাডুতে ৩৬ জন, কেরলে ১৭ জন মারা গিয়েছেন। বছর তিনেক আগে দিল্লি-মহারাষ্ট্রেও ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি ছিল বলে তাঁর দাবি। মমতার কথায়, “২০০৫ সালে এ রাজ্যে ডেঙ্গিতে ৩৪ জন মারা গিয়েছিলেন। এ বছর কর্নাটকে ১৮৫৯ জন, কেরলে ২৬৮৩ জন ও তামিলনাডুর ৪৬৭৫ জনের পাশে এ রাজ্যে ডেঙ্গি-আক্রান্ত হয়েছেন ৬৩৮ জন।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “আক্রান্তের সংখ্যা কম মানেই বাহাদুরির কথা, তা নয়!” তাঁর মতে, ডেঙ্গি নিয়ে রাজ্য সরকারের বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করা উচিত।
বস্তুত, ডেঙ্গির সামগ্রিক চিত্রটা সরকার মানছে না বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকের অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ডেঙ্গি-আক্রান্তের যে তথ্য দিয়েছেন, তা সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের। কিন্তু গত ২৫ অগস্ট থেকে শুধু ই এম বাইপাস সংলগ্ন একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় হাজার দেড়েক ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। পুরসভার ক্লিনিকগুলিতেও প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন নমুনা পরীক্ষার জন্য আসছেন। বামেদের একটি প্রতিনিধিদল এ দিন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করে বলেছে, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে রাজ্যে প্রায় দু’হাজার মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত এবং এ পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। |
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ‘অপপ্রচারের’ অভিযোগ তুলে বেসরকারি নার্সিংহোমগুলির বিরুদ্ধে কার্যত তোপ দেগেছেন। তাঁর কথায়, “নার্সিংহোমগুলোয় আচমকা হানা (সারপ্রাইজ ভিজিট) দেওয়া হবে। পুরোপুরি নিশ্চিত না-হলে কেউ মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি বলে ডেথ-সার্টিফিকেট লিখবেন না।” অপপ্রচারের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “হার্ট অ্যাটাক হলেও ডেঙ্গির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।” নার্সিংহোমগুলির উপরে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই জানিয়েও মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “ডেঙ্গি নিয়ে ব্যবসা করবেন না। আর একটু মানবিক হোন। আশা করব, আমার অনুরোধটাই যথেষ্ট।”
ডেঙ্গি নিয়ে তিনি কোনও ‘আমরা-ওরা’ করতে চান না বলে এ দিন দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তাঁর অভিযোগ, কয়েকটি পুরসভা (যেমন, বামফ্রন্ট-শাসিত হাওড়া) সহযোগিতা করছে না। পঞ্চায়েতের ভোটের আগে কয়েকটি জেলা পরিষদও দায়িত্ব এড়াতে চাইছে বলে জানিয়ে মমতা বলেন, “যে যেখানে আছেন, সেখানে কাজ করতে হবে। ওঁরাও কোথাও কোথাও ক্ষমতায় আছেন।”
যে কোনও মৃত্যু ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে উল্লেখ করেও ডেঙ্গি ছড়ানোর পিছনে ‘প্রাকৃতিক’ কারণ তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “বৃষ্টি হচ্ছে। জল জমছে। মশা তার গতিপথ পাল্টাচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই ডেঙ্গি বাড়ছে।” পরিষ্কার জলেই ডেঙ্গির মশা থাকে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সল্টলেকে পরিষ্কার জল বেশি জমে বলেই সেখানে ডেঙ্গি বেশি।”
গ্রামের থেকে শহরের পরিস্থিতিই খারাপ বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এখন বেলা দু’টোর সময়ে পুরসভার ক্লিনিক বন্ধ করার বদলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চিকিৎসা চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার বেশ কয়েকটি ইউনিট খুলেছে।”
এ দিন সকালে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এসএসকেএম হাসপাতালে যান মুখ্যমন্ত্রী। পরে মুখ্যসচিব, স্বাস্থ্যসচিব, ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনার পরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন। ডেঙ্গির খবর প্রচারে সংবাদমাধ্যমকে সতর্ক হতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনের পাশাপাশি আমজনতা-সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের দায়িত্বের দিকগুলো মনে করিয়ে দেন তিনি। বাড়িতে ফ্রিজের জল, এসি-র জল, ফুলগাছের টবের জল নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে বলার সঙ্গে খাবারের দোকান, মিষ্টির দোকান থেকে বিভিন্ন হাসপাতালকে জঞ্জাল ফেলা বা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক পরিবেশ-বিধি মানতে গিয়ে ধাপায় জঞ্জাল ফেলা বন্ধ হওয়াতেও সমস্যা বাড়ছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সাহায্যে জঞ্জাল শোধন পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কলকাতার ১০ কিলোমিটারের মধ্যেই জঞ্জাল ফেলার ব্যবস্থাও হচ্ছে।” |