তাড়া করে বেড়ায় এক বালকের মুখ।
দিনমজুর পরিবারের সেই বালকের ছিল চমকে ওঠার মতো মেধা। অনায়াসে আয়ত্ত করে ফেলত দু’ক্লাস উপরের পাঠ্যও। তাকে নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে। কিন্তু রাখতে পারেননি। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক রণজিৎ বসুর সংসারে তখন অনেক মুখ। বাবা, জ্যাঠামশায়রা সংসার চালান কৃষি বীজ বিক্রি করে। সেখানে ওই বালকের স্থান হয়নি। প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই কথা কিন্তু আর ভুলতে পারেননি রণজিৎবাবু।
ডুয়ার্সের ধূপগুড়ির নেতাজি পাড়ার বাসিন্দা রণজিৎবাবু বলেন, “ছেলেটি ফিরে গিয়েছিল তার বাড়িতে। তারপর, যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হল। পড়াশোনা আর করতে পারেনি। দিনমজুরি করছে।”
রণজিৎবাবু তখনই ঠিক করে নিয়েছিলেন, তিনি হাল ছাড়বেন না। ওই বালককে তিনি সাহায্য করতে পারেননি। কিন্তু চেষ্টা করবেন, যাতে অন্য এমনই দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রেরা পড়াশোনা করে যেতে পারে। তাই স্থির করেছেন অবসর নেওয়ার পরে যে টাকা পেয়েছেন, তা থেকে ১০ লক্ষ টাকা এবং পৈত্রিক সম্পত্তি ২৩ কাঠা জমিতে দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি আবাসিক স্কুল করবেন। সে জন্য সেই জমি ও টাকা তিনি সরকারের হাতে তুলে দিতে চান। |
কিন্তু আশ্চর্য কথা হল, সরকার ‘উদাসীন’। রণজিৎবাবু বলেন, “আমি বারবার জেলাশাসক থেকে শিক্ষা দফতর পর্যন্ত নানা দফতরে লিখিত আবেদন জানিয়েছি আমার জমি ও টাকা নিয়ে স্কুল তৈরি করা হোক বলে, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে উদাসীনতা ছাড়া আর কিছু পাইনি। সেই ২০১০ সাল থেকে আবেদন করছি। এখনও কিছুই হয়নি।” বাধ্য হয়ে তিনি এ বার সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন। দরবার করেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছেও।
কিন্তু সরকার কেন উদাসীন?
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, তৎকালীন জেলাশাসক রণজিৎবাবুর প্রস্তাবটি জেলা স্কুল পরিদর্শকের দফতরে পাঠিয়েছিলেন। জেলা স্কুল পরিদর্শক নারায়ণ সরকার বলেন, “গত বছর ডিসেম্বরে আমরা ওই জমি পরিদর্শন করেছি। তার কয়েক মাস পরে যে রিপোর্ট আসে, তা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তখন স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে আবার রিপোর্ট চাওয়া হয়। সেটা দু’মাস আগে আমার হাতে পৌঁছয়। তারপরে আমি তা কলকাতায় বিকাশ ভবনে পাঠিয়ে দিয়েছি।” জলপাইগুড়ির বর্তমান জেলাশাসক সারকী মহাপাত্র বলেন, “ওই ভদ্রলোক যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা খুবই ভাল। আমি দেখছি, কত দ্রুত তাঁর এই স্বপ্ন সফল করা যায়।” ধূপগুড়ি পুরপ্রধান শৈলেনচন্দ্র রায় অবশ্য বলেন, “স্কুল হলে খুব ভাল হয়। ওই জমির কাঠা প্রতি দাম এখন ছ থেকে সাত লক্ষ টাকা। বিষয়টি দেখছি।” মন্ত্রী গৌতমবাবু বলেন, “রণজিৎবাবুর চিঠি আমি হাতে পাইনি। তবে এটা একটা মহৎ উদ্দেশ্য। কেন এত দেরি হচ্ছে, তা আমি খোঁজ নিচ্ছি।”
রণজিৎবাবু শালবাড়ি বোর্ড প্রাথমিক স্কুল থেকে ২০০৯ সালে অবসর নেন। তাঁর স্ত্রী মায়াদেবীও একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। নিঃসন্তান এই দম্পতির অবশ্য অনেক দিন থেকেই স্বপ্ন এই আবাসিক স্কুলটি। এখন অবস্থাও ফিরেছে। তাই যথাসর্বস্বই দিয়ে দিতে চান। নিজেরা বাকি জীবন কাটাবেন দু’কাঠা জমিতে টিনের চালার বাড়িতেই।
রণজিৎবাবু বলেন, “দু’জনে যা পেনসন পাই, তাতেই হেসেখেলে চলে যাবে। যদি ক্ষমতা থাকত, তা হলে নিজেই স্কুল তৈরি করে ফেলতাম। কিন্তু এখন বয়স হয়ে গিয়েছে। তাই যা রয়েছে, দিয়ে দিয়েছি, বাকিটা সরকার সাহায্য করুক।”
স্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে। |