আতঙ্কের ছবি যে কতটা গভীর হতে পারে, তা টের পাওয়া যায় এখানে এলেই।
২৪ ঘণ্টা আগে, সোমবার দুপুরে বারাসতের কদম্বগাছির এই এলাকায় দাঁড়িয়ে দুই মহিলার শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করেছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক বিকাশবন্ধু মল্লিক। মত্ত অবস্থায় দুই দুষ্কৃতী পিটিয়ে খুন করে তাঁকে। প্রতিবাদে আজ, বুধবার বারাসত বনধের ডাক দিয়েছে এসইউসি। বন্ধ সমর্থন করছে ফরওয়ার্ড ব্লকও। বন্ধে ছাড় দেওয়া হয়েছে দূরপাল্লার বাস ও ট্রেনকে। বারাসতের মহকুমা পুলিশ অফিসারকে সরিয়ে আপাতত পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন। মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকার মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের পদস্থ কর্তারা। কিন্তু তাতেও আতঙ্কের চিত্রটির পরিবর্তন হয়নি একটুও।
কী রকম সেই আতঙ্ক?
এলাকায় পুলিশি টহল চলছে। তার মধ্যে দাঁড়িয়েও মাঝবয়সী এক মহিলা বলেন, “এক জন মরে গেল। তার পরে ঢল নামল পুলিশের। এ সব দু’দিন চলবে। ফের এলাকায় দাপিয়ে বেড়াবে ওরাই। যে প্রতিবাদ করবে, তার অবস্থা হবে ডাক্তারবাবুর মতো।” আতঙ্কে নিজের নাম পর্যন্ত বলতে চাইলেন না ওই মহিলা। এলাকার অন্য মহিলারাও জানান, নেশাখোরদের দৌরাত্ম্যে তাঁরা একা বাড়ি থেকে বেরোতে ভরসা পাচ্ছেন না। প্রতিবাদ করায় বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
বিকাশবন্ধুর আত্মীয়-পরিজনেরাও এ দিন বিশেষ মুখ খুলতে চাননি। এলাকার সকলের চোখে-মুখেই আতঙ্ক। স্থানীয় এক যুবক বলেন, “কদম্বগাছি-ধর্মতলা চেকপোস্টের ঠিক পিছনে তেঁতুলতলায় চোলাইয়ের ঠেক। পাশে সাট্টা, জুয়া, গাঁজার আসর। মদের বোতল রাখার জন্য বড় গুদামও রয়েছে সেখানে। সবই চলে পুলিশের নাকের ডগায়।”
ঠিক এই জায়গাতেই এসে আটকে গিয়েছেন বিকাশবন্ধুবাবুর প্রতিবেশীরা। তাঁদের আতঙ্কের কারণ, এ সব নিয়ে বেশি মুখ খুললেই সমাজবিরোধীরা ফের এসে গোলমাল পাকাবে। স্থানীয় এক মহিলা বললেন, “আমরা পুলিশের উপরে আর ভরসা রাখতে পারছি না। সমাজবিরোধীদের ব্যাপারে আগেও পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
এ দিন দুপুরে রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) অনিল কুমার ঘটনাস্থলে গেলে তাঁকে একই কথা জানিয়েছেন স্থানীয়েরা। তাঁদের চাপে পড়ে এলাকার সমাজবিরোধীদের চোলাই মদের ঠেকও দেখতে যান তিনি। পরে তিনি বলেন, “এলাকাবাসীর অভিযোগ শুনেছি। পুলিশকে বলেছি অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে।”
বারাসতের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে এ দিন মুখ খুলেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। তিনি বলেন, “বারাসত তো এই ধরনের ঘটনায় নাম করে ফেলেছে। ওঁরা (সরকার) কমিশনারেট করছেন পরিকাঠামো ছাড়াই। সব কমিশনারেটে অপরাধ বেড়ে গিয়েছে। আমরা কমিশনারেট গড়ার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু পরিকাঠামো ছাড়া এ সব হতে পারে না। লোক নেই, জন নেই, বাড়ি নেই, উনি (মুখ্যমন্ত্রী) কখনও কমিশনারেট, কখনও হাসপাতাল গড়ার ঘোষণা করে চলেছেন। তাতে যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে!”
উত্তর ২৪ পরগনায় ব্যারাকপুর এবং বিধাননগর কমিশনারেট গড়তে গিয়ে পুলিশকর্মী তুলে নিয়ে যাওয়ায় জেলা পুলিশের হালও এখন শোচনীয় হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
বারাসতে আতঙ্কের এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে এলাকার মানুষের আস্থা ফেরাতে এ দিন বিকেলেই একপ্রস্ত ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। বারাসতের মহকুমা পুলিশ অফিসার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জায়গায় সেখানে আনা হচ্ছে সুবীর চট্টোপাধ্যায়কে। সুবীরবাবু এক সময়ে বনগাঁয় সমাজবিরোধী নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
অন্য দিকে, চিকিৎসক খুনের ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত সিরাজুল ইসলামকে এ দিন সকালে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সোমবারই মহম্মদ জালালউদ্দিন নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশ জানায়, ঘটনার পরে বছর পঁচিশের সিরাজুল এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গুমায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকেই তাকে ধরা হয়। তার বাড়ি বারাসত থানার সুবিদ আলি বস্তিতে। জালালউদ্দিন থাকে ফরিদা বিবি বস্তিতে। চিকিৎসক খুনের প্রতিবাদে এ দিন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা এবং সারা ভারত মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের লোকজন বারাসত থানায় স্মারকলিপি জমা দেন। |