যৌন নিগ্রহ বলিতে কী বোঝায়? ২০১০ সালে এই প্রশ্ন সম্মুখে রাখিয়া একটি সমীক্ষা করিয়াছিল পুনে’র ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ। আশ্চর্য একটি তথ্য প্রকাশিত হয় ইহাতে। মহিলা-পুরুষ মিলাইয়া প্রায় ৬৬.৫ শতাংশই জানেন না, কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ শব্দবন্ধ দ্বারা ঠিক কী বোঝানো হয়। অধিকাংশেরই ধারণা, শারীরিক নিগ্রহের একটি ধরনই কেবল যৌন নিগ্রহের মধ্যে পড়ে। শারীরিক নিগ্রহেরও যে আরও অনেক প্রকার ধরন রহিয়াছে, কেবল স্পর্শের পদ্ধতিভেদের মাধ্যমেও যে যৌন অনাচার সম্ভব, এবং শারীরিকতার সম্পূর্ণ বাহিরে, নিছক মুখের কথাতেও যে তাহা সম্ভব এ বিষয়ে কোনও সচেতনতাই তরুণ নাগরিকদের একটি বড় অংশের নাই। অথচ তাহা না থাকিলে কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহের শাস্তির দিকে অগ্রসর হওয়াও অসম্ভব, কেননা এই ক্ষেত্রটিতে অভিযুক্তের অনুভূতি এবং বক্তব্যই সমস্ত তথ্যপ্রমাণের মূল ভিত্তি। যে কোনও ধরনের কর্মক্ষেত্রেই মহিলাদের সংখ্যা এখন বিপুল, তাঁহাদের শিক্ষা ও সচেতনতার মাত্রাও পূর্বাপেক্ষা অধিক, কিন্তু নিগ্রহের আইনি সংজ্ঞা ও নিগ্রহ বন্ধের আইনি পথ বিষয়ে তাঁহারা অনেকেই অজ্ঞ। অজ্ঞ পুরুষরাও অনেকেই কোন কোন ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা তাঁহাদের মৌলিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, সেই সচেতনতাও তাই যথেষ্ট নহে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই লোকসভায় কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ বিষয়ক বিলটি পাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। এত দিনে স্পষ্ট ভাবে নিগ্রহের ধরনগুলি নির্ধারণ করিয়া তাহার প্রতিরোধের লক্ষ্যে একটি জোরালো পদক্ষেপ লওয়া হইল। অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মী, গৃহ-পরিচারিকা, কিংবা খেলোয়াড়দেরও এই বিলের আওতায় আনা হইয়াছে, তাঁহাদের কর্মস্থল কিংবা ক্রীড়াঙ্গনকেও স্বীকৃতি দেওয়া হইয়াছে: ইহাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক দশক ধরিয়া ভারতীয় সমাজ এমন একটি আইনের প্রতীক্ষায়। যদিও এত দিন ভারতীয় আইনবিধির কয়েকটি ধারায় নারীদের প্রতি নিগ্রহের প্রতিকারের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল, যেমন ২৯৪ নম্বর ধারায় সর্বসমক্ষে কুরুচিকর কাজকর্ম কিংবা গান গাওয়া নিষিদ্ধ, ৩৫৪ নম্বর ধারায় মহিলাদের প্রতি বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ, ৩৭৬ নম্বর ধারায় ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য, কিংবা ৫১০ নম্বর ধারায় মহিলাদের সম্মানহানি হয় এমন কোনও আচরণ বা ভঙ্গি নিষিদ্ধ। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও একটি সার্বিক যৌন নিগ্রহ আইনের প্রয়োজনীয়তা বারংবার উচ্চারিত হইয়াছে। উল্লেখ করা যাইতে পারে, ১৯৮৮ সালে পুলিশ কমিশনার কানওয়ার পাল সিংহ গিলের বিরুদ্ধে রূপান দেওল বাজাজ-এর যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে যখন গিলকে অপরাধী ঘোষণা করে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত, তাহা ছিল মহিলাদের যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে আইনি অবস্থানের একটি বিশেষ অগ্রগতি: কর্মক্ষেত্রে কোন কোন ধরনের আপাত-নিরীহ ব্যবহারও নারীর সম্মানহানি ঘটাইতে পারে, তাহার স্পষ্টতর রূপরেখা তৈরি হয় এই রায়েরই মাধ্যমে।
আইনের বিভিন্ন খুচরো ধারা সত্ত্বেও এই ব্যাধিটি ভারতীয় সমাজে এখনও অভিযোগ ও শাস্তির চৌহদ্দির অনেকখানি বাহিরে থাকিয়া গিয়াছে। বিশেষত কর্মক্ষেত্রের ক্ষমতা-সমীকরণের প্রশ্নটি যুক্ত হইলে নির্যাতিতরা অভিযোগ জানাইতেও দ্বিধাগ্রস্ত, এমনকী সন্ত্রস্ত বোধ করেন। প্রতি কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতননিরোধী কমিটি তৈরি এই সন্ত্রাস হইতে বাহির হইবার প্রথম পদক্ষেপ। বর্তমান বিলটিতে এই বিষয়টিরও নির্দেশিকা রহিয়াছে, সুখবর। এই বিল আইনে পরিণত হইলে অনেক বিচারের বাণীকে নিভৃত অন্দর হইতে আদালতের অঙ্গনে টানিয়া আনিয়া প্রতিকার সাধন সম্ভব হইবে, আশা থাকিল। আইন যথেষ্ট নহে, সত্য। কিন্তু এই ধরনের ক্ষেত্রে আইন জরুরি, তাহাও মিথ্যা নহে। |