রাজ ঠাকরের সহিত উদ্ধব ঠাকরের একটা প্রতিযোগিতা আছে। শিব সেনা পরিবার হইতে পৃথগন্ন হইয়া মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা তৈয়ার করার পর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হয়। তাই রাজ ঠাকরে যদি বলেন, তিনি মহারাষ্ট্রে বসবাসী এবং কায়িক শ্রমে ব্যাপৃত বিহারিদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিতে প্রস্তুত, উদ্ধব ঠাকরে তবে আরও এক কাঠি আগাইয়া বলেন, বিহারিদের মহারাষ্ট্রে কাজ করিতে কিংবা বাস করিতে হইলে অনুমতিপত্র লাগিবে। ঠাকরে পরিবারের দুই নায়কের এ হেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিহারিদের পক্ষে দুঃসহ হইয়া উঠিতেছে। কেননা ইহার মাধ্যমে বিহারিদের বিরুদ্ধে ‘মরাঠি মানুষ’কে খেপাইয়া তোলার অপকর্মটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতেছে। এমন এক সময়ে এই বিভেদপন্থার অনুশীলন হইতেছে, যখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর লোকেদের উপর অবশিষ্ট ভারতে মুসলিমরা চড়াও হইয়াছেন বড়োল্যান্ডে সংঘটিত দাঙ্গার জেরে। ভারত কি তবে বিভিন্ন আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বেই ক্রমাগত জেরবার হইতে থাকিবে?
বড়োরা বলিবেন, মুসলিমরা বাংলাদেশ হইতে অনুপ্রবেশকারী। মুসলিমরা পাল্টা বড়ো-সহ যাবতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনগোষ্ঠীকেই ভারত হইতে খেদাইতে উদ্যত। মরাঠিরা বলিবেন, বিহারি ও উত্তর ভারতীয়রা মহারাষ্ট্রের সম্পদে ভাগ বসাইতেছেন, তাঁহাদের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ইহার জবাবে সমগ্র উত্তর ভারতে যদি মরাঠি মানুষকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়, তাহাতে কি ভারতের মঙ্গল হইবে? ঠাকরেরা কি বিষয়টি তলাইয়া দেখিয়াছেন? তাঁহারা তো মুম্বই, ঠানে কিংবা পুনের নিরাপত্তায় বসিয়া বিবৃতির ফুলঝুরি ছুটাইতেছেন, অনুগামীদের অভিনন্দন কুড়াইতেছেন। তাঁহাদের উগ্র প্রাদেশিকতা ভারতের অন্যত্র বসবাসকারী মরাঠিদের জন্য কী বিপদ ঘনাইয়া তুলিতেছে, সেটা কি তাঁহাদের খেয়াল আছে? দলিত সংগঠন রিপাবলিকান পার্টির নেতা রামদাস আথওয়ালে ঠাকরে-ভাইদের এই আস্ফালনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া আঁচ করিয়াই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার সহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকারকে অনুরোধ করিয়াছেন মরাঠিদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। প্রশ্ন হইল, আথওয়ালেকে এমন অনুরোধ করিতে হইবে কেন? মহারাষ্ট্র মরাঠিদের, বিহার বিহারিদের, বাংলা বাঙালির, অন্ধ্রপ্রদেশ তেলুগুদের এ ভাবে তো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রাদেশিক পুনর্গঠন হয় নাই!
বিহারি ‘অনুপ্রবেশ’ কিংবা ‘অভিবাসন’-এর কারণে মরাঠিরা কাজ পাইতেছে না, কিংবা মহারাষ্ট্রের সম্পদে বিহারিরা ভাগ বসাইতেছে, এই প্রচারটি ঠিক নয়। বরং সেই সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে মরাঠি মানুষের পাশাপাশি বিহারি তথা অন্যান্য রাজ্যের মানুষদেরও অবদান রহিয়াছে। বড়োল্যান্ড তথা অসমের আর্থ-সামাজিক বিকাশেও যেমন মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। ভূমিপুত্র হওয়ার ভিত্তিতে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যাহারা আগে অভিবাসী, তাহারাই ভূমিপুত্র, পরবর্তী অভিবাসনকারীরা ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’, বসবাস করিতে হইলে তাহাদের ‘পরিচয়পত্র’ লাগিবে কিংবা কাজ করিতে হইলে ‘পারমিট’ এমন ফতোয়া যুক্তি ও প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। কেননা ঠাকরে-লাঞ্ছিত মুম্বইয়ের সমুদ্রতট সহ সসাগরা বিশ্বই একদা জনশূন্য ছিল, মরাঠি মানুষও সেখানে বহিরাগত, অভিবাসী। যেমন বাঙালি বাংলায়, বিহারি বিহারে। |