পুলিশের লাঠির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হবে। আন্দোলনের মরা গাঙে নইলে আর বান আসবে না!
কেরলের উদাহরণ মাথায় রেখে এমন উপলব্ধিই সিপিএম ছাত্র সংগঠনের। পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরল, দুই রাজ্যেই দল ক্ষমতাচ্যুত। কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যে সদস্যসংখ্যা বাড়ছে, পুবে কমছে। দক্ষিণে আছড়ে পড়ছে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ। আর পুবে আন্দোলন স্তিমিত। তৃণমূল-জমানায় পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ‘প্রতিকূল’ বলে মেনে নিয়েও কেরলের ছাত্র-ক্যাডারদের ‘জঙ্গি আন্দোলন’কে গোটা দেশের জন্য ‘মডেল’ করতে চাইছে সিপিএম। মঙ্গলবার শুরু-হওয়া ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনের দলিলে এই মনোভাবই ধরা পড়ছে।
মাদুরাইয়ে এসএফআইয়ের চতুর্দশ সর্বভারতীয় সম্মেলনে বুধবার যে খসড়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ হচ্ছে তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কেরলের পারফরম্যান্সের উপরে। ‘সাংগঠনিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ইউডিএফের ছাত্র-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আমাদের কেরল ইউনিট যে জঙ্গি লড়াই এগিয়ে নিয়ে চলেছে, তা বিশেষ ভাবে দৃষ্টান্তমূলক।’
গত সম্মেলনের পরের ৪৭ মাসে বিভিন্ন রাজ্যে যে লড়াই হয়েছে, তার মধ্যে এসেছে তামিলনাড়ু, কর্নাটক এবং হিমাচল প্রদেশ ও রাজস্থানের সাম্প্রতিক ‘সাফল্যে’র কথা। আর বাংলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকারের গণতন্ত্র-বিরোধী ও স্বৈরতান্ত্রিক কৌশলের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ ইউনিট বড় মতাদর্শগত ও প্রত্যক্ষ সংগ্রামে রয়েছে’।
কেরলে গত দেড় বছরে একের পর এক তুমুল আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েছে এসএফআই। তাদের আন্দোলন পুলিশি প্রতিরোধের মুখেও পড়েছে। লাঠি, কাঁদানে গ্যাস চলেছে। সেই সব ঘটনা নিয়ে হইচইয়ে বিধানসভা অচল হয়েছে। ‘প্রশাসনিক দমন-পীড়নে’র ভয়ে আন্দোলন থেকে সেই রাজ্যের এসএফআই যে পিছিয়ে আসেনি, সেই ধারাকেই তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে সর্বভারতীয় সম্মেলনের দলিলে। সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘প্রবল কুৎসা ও অপপ্রচারে’র মধ্যে কোঝিকোড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএফআইয়ের নিরঙ্কুশ জয়কেও অনুপ্রেরণা হিসাবে দেখানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, কোঝিকোড়েতেই সম্প্রতি টি পি চন্দ্রশেখরনের (সিপিএম ছেড়ে যিনি আরএমপি নামে নতুন দল গড়েছিলেন) হত্যার ঘটনায় সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রে’র অভিযোগ উঠেছিল এবং এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল বিস্তর।
সামগ্রিক ভাবে সাংগঠনিক ব্যর্থতার কথাও কবুল করা হয়েছে দলিলে। বলা হয়েছে, ‘ধারাবাহিক সংগ্রামের চেষ্টা চালানো হলেও কিছু রাজ্যে প্রতীকী কাজ করার মনোভাব রয়ে গিয়েছে’। শুধু উপর তলার কমিটির নির্দেশ মেনে নিচু তলায় বৈঠক এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না-থেকে আন্দোলনের পথই যে সংগঠনকে চাঙ্গা করার উপায়, সেই ‘বাস্তবতা’ই বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এ বার নজর দিতে চাইছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকেও। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের ক্ষোভ-হতাশার প্রতিফলন তাদের সংগঠনের মাধ্যমে ঘটুক, এমনই চাইছে এসএফআই।
কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপের মোকাবিলা করে হিমাচল প্রদেশ ও রাজস্থানের মতো হিন্দি বলয়ের রাজ্যে এ বার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাফল্য পেয়েছে এসএফআই। তবে তুলোধোনা করা হয়েছে দিল্লি রাজ্য কমিটিকে। গত জুলাই পর্যন্ত শেষ ১৫ মাসে একটাও রাজ্য কমিটির বৈঠক যে দিল্লিতে হয়নি। জেএনইউ-তে কী পরিস্থিতিতে কিছু সদস্যের বহিষ্কার-সহ ইউনিট ভেঙে দেওয়ার ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নিতে হয়েছে, তারও বিবরণ রয়েছে দলিলে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে এসএফআইয়ের সদস্য কমেছে ৫ লক্ষ ১০ হাজার ৫৪৭। এই ‘কঠিন সময়’ মাথায় রেখেই কাল, বৃহস্পতিবার সম্মেলনে থাকার কথা প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসু, এম এ বেবি-সহ সুজন চক্রবর্তী, নেপালদেব ভট্টাচার্যের মতো এক ঝাঁক প্রাক্তন ছাত্র-নেতার। দেখার যে, প্রাক্তনীরা কী দাওয়াই দেন বর্তমানদের! |