|
|
|
|
খেলার খবর |
মহিলা ফুটবল দিঘলকান্দিতে
গৌরব বিশ্বাস • দিঘলকান্দি |
|
|
মেরি কমের ছবি সাঁটা রয়েছে পড়ার টেবিলে। মনে মনে তিনিই যেন সাহস জোগাচ্ছেন।
বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই জনাকয়েক মেয়ে চলে যেত গ্রামের মাঠে। মাঠের পাশে বসেই তারা দেখত কী ভাবে একটা ফুটবল নিয়ে মাঠময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ছেলেগুলো। মুরুটিয়ার সীমান্তঘেঁষা গ্রাম দিঘলকান্দিতে মাসকয়েক বাদে ছবিটা কিন্তু বদলে গিয়েছে। বিকেল হলেই গ্রামের সেই মাঠেই ফুটবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে জনা কুড়ি মেয়ে। রবিবার দিঘলকান্দি কিশোর সংঘের পরিচালনায় সেই ঘরের মাঠেই নৈশ ফুটবল প্রতিযোগিতায় একটি প্রীতি ম্যাচ খেলে ফুটবলার হিসাবেই স্বীকৃতি আদায় করে নিল ওই কুড়ি জন ‘সাধারণ মেয়ে’। সেই সঙ্গে তারা ছুঁয়ে ফেলল স্বপ্নের একটা সিঁড়িও।
গত কয়েকমাস ধরেই গ্রামের মাঠে ফুটবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে গোয়াবাড়ি নেতাজী বিদ্যাপীঠের ওই ছাত্রীরা। আর মেয়েদের খেলা দেখতে বাড়ির কাজকর্ম সেরে মাঠেও হাজির থেকেছেন তাদের মায়েরাও। দিঘলকান্দি কিশোর সংঘের সম্পাদক রতন বালা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্বশিক্ষক। রতনবাবুই আপাতত ওই মেয়েদের কোচ। বিকেলে মেয়েদের নিয়ে যখন তিনি অনুশীলন করান, তখন আচমকাই মনে পড়ে যায় চক দে ইন্ডিয়ার কবীর খানকে। রতনবাবু বলেন, “এই মেয়েরা সকলেই খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে। আর্থিক অবস্থাও এমন কিছু ভাল নয়। মাসকয়েক আগে দেখতাম ওরা মাঠের পাশে বসে আমাদের খেলা দেখছে। বল মাঠের বাইরে চলে গেলে লাথি মেরেই ওরা বল মাঠে ফের পাঠাত। হঠাৎ একদিন ওদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম- খেলবি? সঙ্গে সঙ্গে ওরা রাজি হয়ে গিয়েছিল। তারপর ওদের দেখাদেখি একজন একজন করে এখন কুড়ি জন মেয়ে রীতিমত জুতো, জার্সি পড়ে নিয়মিত মাঠে প্র্যাকটিশ করে।” |
|
কিন্তু সীমান্তের এই গ্রাম থেকে মেয়েদের এ ভাবে ফুটবল খেলতে মাঠে নামার অনুমতি দিল তাদের বাড়ির লোকজন? রতনবাবু বলেন, “দিঘলকান্দি এখানেই বোধহয় ব্যতিক্রম। মেয়েদের খেলতে দেওয়ার অনুমতি তো দিয়েইছে, সেই সঙ্গে বাড়ির লোকজনও বিকেলে মেয়েদের খেলা দেখতে মাঠে চলে আসেন।” দিঘলকান্দি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য কার্তিক মণ্ডল বলেন, “মেয়েরা দিঘলকান্দিতে ঘরবন্দি নন। বরং উল্টোটা। সীমান্তে বেঁচে থাকতে গেলে এমনিতেই সবাইকে লড়াই করেই বাঁচতে হয়। তা ছাড়া বছর কয়েক আগেও দিঘলকান্দিকে বলা হত ‘পুরুষ শূন্য’ গ্রাম। গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ তখন পশ্চিম এশিয়ায় কাজে যেতেন। বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম সামলানোর পাশাপাশি বাজার, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসের মতো হাজার ‘ছেলেদের’ কাজগুলোও করতে হত বাড়ির মহিলাদেরকেই। এইগুলো করতে করতে এখানকার মহিলারাও অনেক স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পাশাপাশি অনেক সচেতনও হয়েছেন।” কার্তিকবাবু বলেন, “এলাকার হতশ্রী চেহারা অনেকটাই ফিরেছে। সেই সঙ্গে এলাকার শিক্ষিতের হারও বেড়েছে আগের থেকে অনেক বেশি। এলাকায় কোন স্কুল ছুট নেই আর সেই কারণেই সঙ্কীর্ণতাও অনেকটা কেটেছে। তাই এখানকার মেয়েরা ফুটবল খেলার সাহস দেখিয়েছে। ওই মেয়েরা শুধু দীঘলকান্দি নয়, ওরা গোটা এলাকার গর্ব।” করিমপুর আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক দীপঙ্কর সাহা বলেন, “এটা সত্যিই নজিরবিহীন ঘটনা। সীমান্তের প্রত্যন্ত এই গ্রাম থেকে ওই মেয়েরা পায়ে ফুটবল নিয়ে আমাদের সবাইকে একটা বড় বার্তা দিল। ওদের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে কথা বলে ওই মেয়েদের সাহায্য করার সবরকম চেষ্টা করব।”
অন্য দিনের মত শনিবারেও মেয়েদের প্র্যাকটিস দেখতে মাঠে এসেছিলেন রীণা কীর্তনিয়া, সীমা মৌলিক, রেবতী বিশ্বাসরা। তাঁরা বলেন, “মেয়েরা যখন বাড়ি গিয়ে ফুটবল খেলার কথা বলল, আমরা ওদের বাধা দিইনি। টিভিতে এখন দেখতে পাই কত মেয়েরা খেলাধূলা করছে। সবাই ওদের নিয়ে কেমন নাচানাচি করছে। তাই আমাদের মেয়েরাও যদি তেমন কিছু করতে পারে, তবে সেটা তো ভালই।” ফুটবলার ওই ছাত্রীদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত ওদের স্কুলের শিক্ষকরাও। ভূগোলের শিক্ষক কুন্তল বিশ্বাস বলেন, “ওরা আমাদের স্কুলের গর্ব।” |
|
|
|
|
|