বারবার তিন বার: ২০০৭ • ২০০৯ • ২০১২
ভারতীয় ফুটবলে নবজাগরণ
ভারত-২ (৫) (গৌরমাঙ্গী, সুনীল-পেনাল্টি)
ক্যামেরুন-২ (৪)(মাকন, এমপোন্ডো)
টাইব্রেকারে ক্যামেরুনের মাকন থিয়েরির অন্তিম শট সুব্রত পালকে উল্টো দিকে ফেলে দিয়েও পোস্টে ধাক্কা খেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই মাঠের দু’পাস দিয়ে নামতে শুরু করল জনস্রোত। নেহরু স্টেডিয়ামের ফেন্সিং টপকে পাগলের মতো দৌড়চ্ছে মানুষ। অন্তত এক বার সুনীল ছেত্রী, সুব্রত পাল, রহিম নবি, মেহতাব হোসেনদের ছুঁতে।
নেহরু কাপ জয়ের হ্যাটট্রিক করে ইতিহাস গড়া ‘নতুন ভারত’ তখন জাতীয় পতাকা নিয়ে চক্কর দিতে শুরু করে দিয়েছে। গ্যালারিতে নাগাড়ে চলছে মেক্সিকান ওয়েভ। সুনীল ছেত্রীর নেতৃত্বে গোটা টিম দৌড়চ্ছে। তার পিছনে কয়েকশো সমর্থক। পুলিশের লাঠিও তাদের কাছে বাধা হয়ে উঠতে পারছে না।
এ রকম জাতীয়তাবাদী দৃশ্যপট তো ভারতীয় ক্রিকেট দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই দেখা যায়! সচিন-ধোনিরা জেতার পর বল্গাহীন উচ্ছ্বাস। কিন্তু হাউটনের ভারতের জয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে কোভারম্যান্সের ভারত রবিবার যা করল, তাকে অত্যাশ্চর্য বললেও কম বলা হয়।
উল্লাস। ট্রফি হাতে অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। রবিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই
ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ১০৯ ধাপ এগিয়ে থাকা ‘আফ্রিকান সিংহ’কে মাথা নত করিয়ে দিয়ে ‘ঘুমন্ত বাঘ’ জেগে উঠল দিল্লিতে। ২০০৭, ২০০৯-র সঙ্গে ২০১২-র জয়ের পার্থক্য একটাই। সিরিয়া নয়, কোভারম্যান্স-ব্রিগেড হারাল এমন একটা দলকে বিশ্বকাপের মঞ্চেও যাদের লড়াইকে কুর্নিশ করে ফুটবলদুনিয়া।
‘উইম’ থেকে ‘উইন’ কোভারম্যান্স নাম হয়ে গেল ভারতের নতুন ডাচ কোচের।
অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী নেহরু কাপে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বাধিক গোল করার সংখ্যায় টপকে গেলেন ভাইচুং ভুটিয়াকে। দ্বারকার ফুটবল হাউসে সোমবার থেকে লাগানো থাকবে কোভারম্যান্স বিগ্রেডের ট্রফি হাতে ছবি। যার নীচে লেখা থাকতেই পারে ভারতীয় ফুটবলে নবজাগরণের চিত্রনাট্য। এই ভারত দেখাল অসম যুদ্ধও কেমন করে জিততে হয়। ভারতীয় ফুটবলের আর্কাইভে চিরদিনের জন্য হয়তো জায়গা করে নিল ২ সেপ্টেম্বর ২০১২-র ওই রুদ্ধশ্বাস ১২০টা মিনিট আর হাড়হিম করে দেওয়া টাইব্রেকার।
ট্রফি জিতে অধিনায়ক সুনীল।
১-০ থেকে ১-২ পিছিয়ে পড়ে ২-২। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ৫-৪ গোলে শেষ মিনিটে জয়। রবিন, সুনীল, ডেঞ্জিল, মেহতাব, ক্লিফোর্ডক্যামেরুনের হয়ে অলিম্পিক খেলা গোলকিপারকে পরাস্ত করে প্রত্যেকটাই গোল। এ রকম জয় ভারতীয় ফুটবল কখনও দেখেছে? শক্তি, স্ফূর্তি, গোলার মতো শট আর দুর্দান্ত পাসে মন কেড়ে নেওয়া আফ্রিকান সিংহকে যে ভাবে শুধু জেদ আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বশ মানিয়ে ফেলল ‘নীল বাঘে’রা তা অকল্পনীয়। পায়ের পেশিতে টান ধরছে। তাতে কী? দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেলেন নবি-ক্লিফোর্ডরা। ফুটবলের ঈশ্বর তা হলে সত্যিই সাহসীদের সহায় হন!
ফাইনালের এক ঘণ্টা পরেও চোখে লেগে রয়েছে কত ঘটনা।
কেমন করে ভোলা যাবে সুনীল ছেত্রীর চার বড় চেহারার আফ্রিকান ফুটবলারকে টপকে সেই অসাধারণ দৌড়টা। যা থেকেই পেনাল্টি আদায় করে নিয়ে ম্যাচের মোক্ষম সময়ে ২-২ করে ফেলল ভারত। সুনীলের শটেই। আর ক্লিফোর্ডের ফ্রিকিক থেকে গৌরমাঙ্গীর জীবন পণ রেখে হেডের গোল! মেরি কমের রাজ্যের রক্ত যাঁর গায়ে, তাঁকে ঠেকাবে কোন আফ্রিকান সিংহ!
হ্যাটট্রিকের হুঙ্কার। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়া
আজ ম্যাচ শুরুর আগেই দেখা গিয়েছিল মাঠের দু’প্রান্তে দু’জন করে ফুটবলার দাঁড় করিয়ে উঁচু কিক মারাচ্ছেন ভারতের ডাচ-কোচ। ক্লিফোর্ডের সঙ্গে তখন জুটি গৌরমাঙ্গী। কী আশ্চর্য! সেই ক্লিফোর্ডের ফ্রিকিক থেকেই ম্যাচের প্রথম গোল গৌরমাঙ্গীর। রক্ষণে সবথেকে লম্বা এবং ঠান্ডা মাথা বলে বব হাউটনের আমল থেকেই গৌরমাঙ্গীর জন্য বাঁধা নিয়ম ছিলবিপক্ষ বক্সের কাছাকাছি ভারতের যে কোনও ফ্রিকিক বা কর্নারের সময় তিনি উঠে যাবেন। এ দিন তীব্র চাপে পড়া অবস্থায় গৌরমাঙ্গীর গোলটাই অক্সিজেন দিয়েছিল সুনীলদের। মাঠ জুড়ে তখন শুধুই উড়ছে তেরঙ্গা। বেজে চলেছে গোর্খা রেজিমেন্টের ব্যান্ড। ভিভিআইপি বক্সের এক দিকে জনা তিরিশেক ক্যামেরুন সমর্থক পাল্টা স্লোগান-যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। গৌরমাঙ্গী হেডে যখন ১-০ করলেন, মাঠে তখন ভারত দশ জনে খেলছে। অধিনায়কই চোট পেয়ে সাময়িক বাইরে ছিলেন।
গোলের সময় গৌরমাঙ্গীর সঙ্গে সংঘর্ষে হাতে চোট পেয়ে বসে যেতে হয় ক্যামেরুন গোলকিপার নোগমি লরেন্সকে। পরে তাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। বদলি গোলকিপার যেন পয়া হয়ে উঠলেন ক্যামেরুনের। তিনি নামার পরেই সিংহের বিক্রম আরও বেড়ে গেল। সেই সময়ই রাজু গায়োকোয়াড় ভুলটা করলেন। নিজেদের বক্সের ঠিক বাইরে হেড করে বল তুলে দিলেন এই মুহূর্তে ক্যামেরুন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা মেকনের পায়ে। পঁচিশ গজ দূর থেকে নেওয়া তাঁর শটে এত জোর ছিল, সুব্রতর মতো গোলকিপারও নড়ার সময় পাননি। নিয়তির কি পরিহাসসেই মেকনই টাইব্রেকারে একমাত্র ব্যর্থ।
ভারত ১-২ পিছিয়ে থাকার সময়ও গ্যালারি অবশ্য দমে যায়নি। ইডেন বা ওয়াংখেড়েতে সাধারণত যা দেখা যায়, ছুটির দিনের বিকেলে নেহরু স্টেডিয়ামের বাইরে ম্যাচের আগে দেখা গেল সেই দৃশ্য। ছেলেমেয়েরা দলে দলে মুখে জাতীয় পতাকার রং মেখে, তেরঙ্গা নিয়ে হাজির। ম্যাচের সময় সারাক্ষণ তারা চেঁচিয়েছে।
এমপোন্ডাদের সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠছেন না। বড় চেহারার সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যাচ্ছেন মেহতাব, ক্লিফোর্ড, নির্মল ছেত্রীরা। শরীর দিচ্ছে না। কিন্তু আবার কোন এক অদৃশ্য যাদুকাঠির ছোঁয়ায় উঠে দাঁড়াচ্ছেন। ঝাঁপিয়ে পড়ছেন লড়াইয়ে।
কোনও ফর্মেশন কিংবা স্ট্র‌্যাটেজি নয়। কোভারম্যান্সের হাত ধরে ভারতীয় ফুটবলের নবজাগরণের রসায়নঅদম্য ইচ্ছাশক্তি। অদম্য সিংহকেও যা দিয়ে বশ মানানো যায়! বশ মানানো সম্ভব!

ভারত: সুব্রত, নির্মল (ডেঞ্জিল), গৌরমাঙ্গী, রাজু, নবি, সঞ্জু (রবিন) মেহতাব, লেনি, ক্লিফোর্ড, ফ্রান্সিস, সুনীল।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.