সহারা গোষ্ঠীর দুই সংস্থাকে লগ্নিকারীদের টাকা সুদ-সহ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই নির্দেশ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। কারণ, ৪৯ জনের বেশি মানুষের কাছে শেয়ার কিংবা ডিবেঞ্চার (ঋণপত্র) কেনার আবেদন পাঠালে যে তা ‘পাবলিক অফার’ বলে গণ্য হবে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, এই ভাবে শেয়ার বা ডিবেঞ্চার ইস্যু করতে হলে, তা শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক ‘সেবি’-র নিয়ম মেনেই করতে হবে। সেই সঙ্গে তা নথিবদ্ধও করতে হবে বাজারে।
সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে সেই সব সংস্থার মোটা তহবিল সংগ্রহের (সাধারণ মানুষের কাছ থেকে) পথ বন্ধ করবে, যারা শেয়ার বা ডিবেঞ্চার ইস্যুর মাধ্যমে তা করলেও শেয়ার এবং ডিবেঞ্চার বাজারে নথিবদ্ধ করতে চায় না। তাই সেবি-র এই জয় নিঃসন্দেহে সুরক্ষা দেবে অসংখ্য ছোট লগ্নিকারীকে। বিশেষত ছোট শহর, মফসস্ল এবং গ্রামের অসংখ্য সাধারণ লগ্নিকারীকে। যাঁদের শেয়ার ও ডিবেঞ্চার সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা নেই। কিংবা যাঁরা সংস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর না-নিয়েই টাকা ঢেলেছেন সেখানে। যে সব সংস্থা শেয়ার বা ডিবেঞ্চার নথিবদ্ধ না-করেও টাকা তুলছে, তাদের উপরও সেবি-র নিয়ন্ত্রণ জারি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাধারণ মানুষের কাছে শেয়ার বা ডিবেঞ্চার ইস্যু করতে হলে তা সেবি-র নিয়ম মেনে করতে হয়। এবং তা নথিবদ্ধ করতে হয় শেয়ার বাজারে। দেখা হয় যে, কেউ ভুল তথ্য অথবা ভুল বার্তা দিয়ে লগ্নিপত্র বাজারে ছাড়ছে কিনা। একটি সংস্থা বাজারে নথিবদ্ধ হলে তাকে সেবি-র নিয়ম মেনে নিয়মিত তথ্য দাখিল করতে হয়। লগ্নিকারীদের নিয়মিত নজর থাকে তার কাজকর্মের উপর। ফলে স্বচ্ছতা বাড়ে।
কিন্তু সেবি-কে এড়িয়ে যে সব সংস্থা বিপুল টাকা বাজার থেকে সংগ্রহ করেছে, তারা তা কোথায় কতটা লগ্নি করেছে এবং সেই সব ব্যবসা কেমন চলছে, তার পুরো তথ্য লগ্নিকারীদের কাছে অনেক সময়ই পৌঁছয় না। লগ্নির অনেকটাই সংগ্রহ করা হয় আধা শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে, যাঁদের অনেকেরই আর্থিক ক্ষমতা বা সাক্ষরতা নেই বললেই চলে। ফলে এঁরা বেশি প্রশ্ন করতে পারেন না। এক জনকে দেখে অন্য জন লগ্নি করেন বিশেষ কিছু না জেনেই।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রলুব্ধ করে বাজারের তুলনায় অনেক বেশি আয়ের হাতছানি। মোটা কমিশন দেওয়া হয় এজেন্টদেরও। যেখানে মন্দার বাজারে অনেক প্রতিষ্ঠিত নামী সংস্থা ব্যবসায় সাফল্য ধরে রাখতে হিমশিম, সেখানে কিছু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নতুন সংস্থা সুদ ও কমিশন বাবদ এতটা খরচ করেও নানা ব্যবসায় কী করে সাফল্য পাচ্ছে, তা নিয়ে রীতিমতো ধন্দে বিশেষজ্ঞরা। আর এই সব কারণেই দেরিতে হলেও সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন অভিজ্ঞ লগ্নিকারীরা। তাঁদের মতে, এতে সুরক্ষা বাড়বে সাধারণ লগ্নিকারীদের।
সহারা গোষ্ঠীর দুই সংস্থা (সহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট কর্পোরেশন ও সহারা হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন) ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ২.৩ কোটি মানুষের থেকে সংগ্রহ করে ১৭,৪০০ কোটি টাকা। ১৫% সুদ-সহ তা ৩ মাসের মধ্যে লগ্নিকারীদের ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই অঙ্ক কমবেশি ২৪ হাজার কোটি।
প্রশ্ন হল, অন্যান্য যে সব সংস্থা বাজার থেকে মোটা টাকা সংগ্রহ করেছে, তাদের বিষয়ে সেবি কী পদক্ষেপ করবে? কোনও কোনও সংস্থার বিজ্ঞাপন অনুযায়ী এরা একই সঙ্গে পরিকাঠামো, রিয়েল এস্টেট, হোটেল, শিক্ষা, মিনারেল ওয়াটার ইত্যাদি শিল্পে নিযুক্ত। অনেকেই পরিচয় দেয় ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ হিসেবে। হঠাৎ এদের সব টাকা ফেরত দিতে বলা হলে কী দাঁড়াবে, তা অনুমান করা শক্ত নয়। তাই বল এখন সেবি-র কোর্টে। সাধারণ মানুষের এখন উচিত নথিবদ্ধ নয়, এমন সংস্থার শেয়ার ও ডিবেঞ্চারে লগ্নি না করা। আর যে কোনও সঞ্চয় প্রকল্পে লগ্নির আগেই অবশ্যই বিস্তারিত ভাবে খোঁজ নিতে হবে সেই প্রকল্পের বিষয়ে। |