ভ্যানকাকু ও মিনিরা
জও দেরি। কী জবাব দেবে দিদিমণিদের? মাসে মাসে সাড়ে সাতশো টাকা। কম তো নয়। যদি বরখাস্ত করে দেন! কিন্তু পবনের কী দোষ? যদি এই চৌরাস্তার মোড়টায় রোজ এই সময় জ্যাম লাগে!
ভ্যানের ভিতরে যেন মাছের বাজার। মাত্র দুটো মেয়ে দুটো ছেলে। কিন্তু কী গলার আওয়াজ! মাথা ঘুরে যায়। সবচেয়ে বেশি আওয়াজ চক্কোত্তিবাবুর মেয়ে মিনিটার। আজ আবার হাতে একটা ঘড়িও বেঁধে এসেছে। নকল না আসল? আসলই তো মনে হচ্ছে। দেখতে জানে নাকি? বলা যায় না। এক ফোঁটা এক ফোঁটা সব ছেলেমেয়ে, ব্যাগ তো বইতে ঠাসা।
পবন প্যাডেলে চাপ দেয় জোরে।
‘ভ্যানকাকু, আজও দিদিমণিরা তোমাকে বকবে।’ খাঁচা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে সেই মিনিই। পবনের শরীরটা আজ তেমন জুত নেই। তার উপর জ্যাম কাটাতে অনেক বেগ পেতে হল। মিনির কথায় ও বেজায় চটে। বলে, ‘কেন, বকবে কেন? আমি কি কারও খাই না পরি? ভ্যানে করে তোমাদের নিয়ে যাই, ওঁরা ন্যায্য মজুরি দেন। একটু-আধটু লেট তো হতেই পারে।’
কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে এক ফোঁটা মেয়েটা। বলে, ‘একটু-আধটু লেট! আমাদের স্কুল শুরু হতে তো আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। এখনও তো অনেকটা রাস্তা।’
বিশ্বাসবাবুর একটু কম কথা বলা ছেলে পিকলু বলে, ‘রোজই লেট! ভ্যানকাকুর এ বার রিটায়ার করা দরকার। বাবা বলছিল, ভ্যানকাকুর বয়স নাকি বাবাদের থেকেও বছর দশেক বেশি হবে।’
পবনের মেজাজ এ বার সপ্তমে চড়ে। ‘তোমার বাবার থেকে দশ বছরের বড় যখন, তখন তো ভ্যানজেঠু বললেই পারো। ভ্যানকাকু বলার দরকার কী!’
স্বাগতা বলে, ‘কী যে বলো! তুমি তো সবার ভ্যানকাকু। বাবাদেরও। বাবা যখন আমাকে রোজ শুধোয়, তুমি রাস্তায় কত বার দাঁড়িয়েছ, কত বার জল খেয়েছ, কখন ভ্যান ইস্কুলে ঢুকিয়েছ, তখন তো বাবা তোমাকে ‘ভ্যানকাকু’ বলেই বলে।’
বুঝেছি বুঝেছি, আমরা হলাম... বলে কী একটা বলতে যায় পবন। কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। বিশাল হর্ন দিয়ে, একেবারে ভ্যানের গা ঘেঁষে বেরিয়ে যায় একখানা সরকারি বাস।
ছবি: সুমন চৌধুরী
রাস্তার পাশে একটা বিয়ে বাড়ি। জমকালো প্যান্ডেল। এ বার ওদের চোখ যায় ও দিকে। মিনিই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ওদের বলে, ‘দ্যাখ, দ্যাখ কী সুন্দর!’
বাবাই বলে, ‘আমার মাসির বিয়েতেও এ রকম হয়েছিল। বোধ হয় আরও বড়।’
স্বাগতা বলে, ‘এখানে নেমন্তন্ন হলে বেশ হত। কেমন খেতাম আমরা বাবা-মা’র সঙ্গে! জানিস তো নেমন্তন্ন খেতে আমার দারুণ লাগে।’
এই সব কথাবার্তা চলছে এমন সময় ভ্যান হঠাৎ থেমে যায়। বিয়েবাড়িটা একটু ছাড়িয়ে। ইস্কুলের ঠিক আগে আগে।
কী হল ভ্যানকাকু?
থামলে যে!
অতবড় লোকটার কেমন কাঁদো কাঁদো মুখ। বলে, ‘মাথা ভেঙে পড়ে যাবে গো। ভীষণ ব্যথা করছে। আমি আর যেতে পারব না।’
ভ্যান থেকে নেমে রাস্তার পাশে বসে পড়ে পবন।
ভ্যান থেকে বেরোয় দুটো মেয়ে দুটো ছেলে। মিনি বলে, ‘তোরা দাঁড়া। আমি, ওই যে ওষুধের দোকান, ওখানে যাই। যদি ওষুধটষুধ পাওয়া যায়!’
একা একা রাস্তা পার হওয়া জীবনে এই প্রথম। দু’পাশ দেখে নিয়ে এক ছুটে রাস্তা পার হয় মিনি। তার পর ওষুধের দোকানে ঢুকে সোজা চলে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাদের ভ্যানকাকুর অসুখ। বসে আছে রাস্তার পাশে।’
বছর তিনেকের একটা মেয়েকে ইস্কুলের পোশাকে হঠাৎ চেম্বারে ঢুকতে দেখে ডাক্তারবাবু প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। এ বার কথা শুনে আরও অবাক।
— কোথায় তোমাদের ভ্যানকাকু? চলো তো...। রোগী ফেলে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে আসেন।
মিনির সঙ্গে যেতে যেতে হেসে বলেন, ‘ভিজিট দিতে পারবে তো?’
ভিজিট ব্যাপারটা মিনি জানে। ক’দিন আগে জ্বর হয়েছিল। বাবা-মা’র সঙ্গে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ভিজিট ব্যাপারটা তখনই জেনেছে। ভিজিট মানে কিছু টাকা। ওটা ডাক্তারকে দিতে হয়। তবে কত টাকা তা অবশ্য ও জানে না। সেটা যা-ই হোক দিয়ে দেওয়া যাবে, সবার স্কুলব্যাগেই কিছু না কিছু আছে।
মিনি ডাক্তারবাবুর কথায় ঘাড় নাড়ে।
ডাক্তারবাবু পবনকে ভাল করে দেখেন। তার পর নিজে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে খাইয়ে দেন।
মিনি ততক্ষণে ভিজিট জোগাড় করে ফেলেছে। ওদের ব্যাগ হাতড়ে যা হয়েছে তাই। সতেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা। ডাক্তারবাবুকে দিতেই উনি হেসে গড়িয়ে পড়েন। বলেন, ‘ভিজিট দিলে, কিন্তু ওষুধের দাম?’
মিনিরা এ ওর মুখের দিকে চায়। ডাক্তারবাবু টাকাগুলো মিনির হাতে ফেরত দিয়ে বলেন, ‘তোমাদের ভ্যানকাকুর অসুখ, আমি কি ভিজিট, ওষুধের দাম নিতে পারি? রাখো এটা।’
এ বার মিনি, স্বাগতা, বাবাই, পিকলুদের কানে কানে কী বলে। তার পর যন্ত্রণায় চোখ বোজা পবনের কানের কাছে মুখ এনে ডাকে ‘ভ্যানকাকু, ও ভ্যানকাকু! এই টাকাটা রাখো। কিছু কিনে খাও।
খেয়ে ওই দোকানের বেঞ্চেতে একটু শুয়ে ভাল হয়ে নাও। আর তো একটুখানি রাস্তা। ঠিক আমরা হেঁটে চলে যাব।’
মিনিরা চার জন রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে। পবন আধবোজা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। এই ছেলেমেয়েগুলোর উপরই একটু আগে ও রাগ দেখিয়েছে, ভাবতে খারাপ লাগে। ‘ভগবান ওদের যেন কোনও বিপদ না হয়!’ ঠোঁট দুটো অজান্তেই নড়ে ওঠে পবনের। মিনিদের ভ্যানকাকুর।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.