যত দিন পড়ি আর শুনি, তত দিন শিখি
ভালবাসা ডাকল তাকে, বলল, ‘নেবে আমায়?’
ইথই জল চার দিকে। তারই মধ্যে মাথা তুলে জেগে আছে ছোট্ট, সবুজ এক টুকরো দ্বীপ। গলাগলি করে সেখানে থাকে সুখ, দুঃখ, প্রজ্ঞা, সম্পদ,...আরও নানান সহ অনুভূতি, মায় ভালবাসাও।
এক দিন, জানা গেল, সবুজ দ্বীপখানি জলে ডুবে যাবে। সবাই যেন যে যার পথ দেখে নেয়। অন্য কোথাও চলে যাবার পথ।
অন্যরা নৌকো বানাল একে একে, চলে গেল। রয়ে গেল কেবল ভালবাসা। ‘থাকি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত’, ভাবল সে।
দ্বীপটা যখন একেবারে ডুবুডুবু, ভালবাসার যাবার সময় হল।
নৌকো করে যাচ্ছিল সম্পদ। ‘নেবে আমায়?’ ভালবাসা শুধোল। ‘কী করে নিই? দেখছ না, সোনা-রুপোয় ভরা আমার নাও, তোমার স্বস্তিতে দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও নেই যে!’ চলে গেল নৌকো।
দম্ভ যাচ্ছিল, ভালবাসা ডাকল তাকে। ‘নেবে আমায়?’ ‘না, না! কেমন ভেজা ভেজা, স্যাঁতসেঁতে গা তোমার, আমার নৌকো নষ্ট হয়ে যাবে। নেবই না!’ চলে গেল।
দুঃখকে শুধোতে সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘নিজেকে নিয়েই বাঁচিনে, তোমায় নিই কেমন করে?’ চলে গেল নাও।
সুখ আর আনন্দ এতই বিভোর আর মশগুল, ভালবাসার ডাক শুনতেই পেলে না। হঠাৎ কার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। ‘এসো, ভালবাসা, আমার নৌকোয় নেব তোমায়।’ বুড়োটেপানা একটা লোক। ভালবাসার এত ভাল লাগল সে ডাক পেয়ে, লাফিয়ে উঠল নৌকোয়, আর খুশিতে ভুলেই গেল বুড়োর নাম শুধোতে।
নৌকো ডাঙায় পৌঁছতে, বুড়ো মতো লোকটা নিজের মনে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলে গেল। ভালবাসা, তীরে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক বুড়ি, প্রজ্ঞাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ও কে গো, আমায় নিয়ে এল?’
‘সময়’, প্রজ্ঞার ছোট্ট উত্তর।
সময়? অবাক হয়ে ভালবাসা তাকাল প্রজ্ঞার মুখে। মৃদু হেসে বলল প্রজ্ঞা, ‘সময়ই যে শুধু বলতে পারে, ভালবাসার মূল্য কতখানি!’

আলেকজান্ডারের শেষ ইচ্ছা
রাজ্যজয় সাঙ্গ হয়েছে, ভাণ্ডারে জমেছে বিপুল বৈভব। সুদূর ম্যাসিডোনিয়ার পথে ফেরার সময় বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার পড়লেন অসুখে। প্রাণঘাতী সে রোগ, ক্রমে শয্যা নিলেন, মৃত্যুর ছায়া ঘনাল শিয়রে। ঘরে ফেরা আর হল না বুঝি এ যাত্রায়।
বয়সে যুবক, কিন্তু দেখেছেন, জেনেছেন অনেক। অন্তিম কাল সমাসন্ন, আলেকজান্ডার বুঝতে পারলেন এই পরাক্রম, শৌর্য স্বর্ণসম্পদের অসারতা, জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব।
কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পাংশুমুখ সেনাপতিদের ডেকে বললেন, মরতে চলেছি আমি। ম্যাসিডোনিয়ার ভূমিস্পর্শ হয়তো আর সম্ভব নয়। তোমরা জেনে নাও আমার শেষ ইচ্ছাত্রয়।
এক, আমার শববাহী কফিন যেন কেবল আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাই বহন করেন। অন্য কেউ নয়।
দুই, যে পথে আমার মৃতদেহ যাবে, সে পথ যেন আমারই ভাণ্ডারের, আমারই অর্জিত রজতকাঞ্চনমুদ্রায়, মণিমঞ্জুষায় আবৃত থাকে।
তিন, আমার মৃতদেহ কফিনের মধ্যে শায়িত রেখো, কেবল হাত দু’টি ঝুলিয়ে দিও কফিনের বাইরে দু’দিকে।
শোকাকুল সেনাপতিদের এক জন আবেগে, বিনয়ে জিজ্ঞেস করলেন এই ইচ্ছাত্রয়ীর অর্থ। আলেকজান্ডার বললেন
‘মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু সত্য। কোনও চিকিৎসকই মৃত্যুকে পরাজিত করতে, অস্বীকার করতে পারেন না। মানুষ যেন তা বুঝতে পারে।
দ্বিতীয়, ধনসম্পদে মুড়ে দেওয়া রাস্তা আমার গৌরবের চিহ্ন নয়। মানুষ জানুক, একটি কাঞ্চনমুদ্রাও সে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না, পরপারে।
আমার হাত দু’টি ঝুলিয়ে রেখো কফিনের দু’পাশে লোকে জানবে, আমি শূন্য হাতে এসেছিলাম পৃথিবীতে, যাচ্ছিও তাই।’
সাধে বলে, আলেকজান্ডার, দি গ্রেট!

সারা রাত জ্বলেছে সুদূর
বাদশাহ আকবরের সঙ্গে বাজি লড়েছেন বীরবল টাকার জন্য মানুষ স-ব করতে পারে কিনা তাই নিয়ে। বীরবল নিয়ে এলেন গরিব এক ব্রাহ্মণকে, তার পরিবার অভাবে জর্জর। বাদশা বললেন, কনকনে ঠান্ডায় বরফ-জলে সারা রাত কাটাতে হবে আকাশের তলায়। ইনামের জন্য ব্রাহ্মণ তাতেও রাজি।
ভোর হল। সবাই এসে দ্যাখে, ব্রাহ্মণ দিব্যি বেঁচে। ‘কী করে রইলে হে, এই ঠান্ডায়?’ ব্রাহ্মণ বললে, কিলোমিটার খানিক দূরে একটা স্তম্ভের মাথায় আলো জ্বলছিল সারা রাত। ওর দিকে তাকিয়েই কেটে গেল।
আকবর বাদশা রেগে আগুন। এ তো প্রতারণা! আলো দেখে সারা রাত ওই উত্তাপে কাটিয়ে দেওয়া! বিনা ইনামে দূর করে দিলেন তাকে।
তার পর ক’দিন বীরবলের দেখা নেই। বাদশা নিজে গিয়ে দেখেন, বীরবল কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে খিচুড়ি রাঁধছেন, কিন্তু পাত্রটা আগুনের শিখা থেকে মিটারখানেক ওপরে।
‘ও কী করছ, অত দূরের আগুনের আঁচে রান্না হয় বুঝি?’ বাদশা হাসলেন।
‘জাঁহাপনা, অত দূরের রাস্তার আলো যদি ব্রাহ্মণের গা সারা রাত গরম রাখতে পারে, তার কাছে এ তো নস্যি!’
বাদশার মুখে কুলুপ।

মানুষ এক জনই দেখলুম
মনিব চাকরকে বললেন: পাশের বাড়িতে মহা ধুমধামে কী উৎসব হচ্ছে। দেখে আয় তো, ঠিক ঠিক কত জন মানুষ এসেছে? ভাল করে গুনবি কিন্তু। চাকর মনিবের হুকুম তামিল করতে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল একটা বড় মতো কাঠের টুকরো। উৎসব-বাড়ির দরজার মুখেই সেটাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে বসে রইল একটু দূরে। লোকজন একে একে বেরোচ্ছে খেয়েদেয়ে, দরজায় হোঁচট খাচ্ছে কাঠের টুকরোয়, তেড়ে গালাগাল দিচ্ছে সেটাকে, তার পর ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে। শেষে এল এক বুড়ি, সেও হোঁচট খেল, কিন্তু গালাগাল দিল না। আস্তে আস্তে হাত দিয়ে সরিয়ে দিল সেটাকে দরজার সামনে থেকে। পরে যে জন আসবে, সে আর হোঁচট খাবে না।
চাকর ঘরে ফিরে মনিবকে জানাল, ‘বাবু, মানুষ এক জনই দেখলুম।’

অত্যাগসহন
সাকুল্যে বত্রিশ পাতার একখানি চটি বই। গোলাপি কভারের মধ্যে ঢাকা নিউজপ্রিন্ট-এর পাতাজোড়া স্বর-ব্যঞ্জন বর্ণেরা ড্যাবাড্যাবা ফন্টে তাকিয়ে, শিশুমনের দোরগোড়ার দিকে। মাঝামাঝি ইস্তক অ-আ-ই-ঊ-ঋ-ঔ এর উদাহরণের চাদরের ঢেকে শব্দদের আগমন, শৈশব-অন্তরে সদ্য-ফোটা ভোকাবুলারির উতল কলকলানি। বাইশ নম্বর পাতায় সেই যে এল ‘প্রথম পাঠ’, তার পর থেকে জীবনভর চেতন-অচেতন-অবচেতনের পরতে পরতে তার সহ-বাস। কথা শুন। মুখ ধোও। ধীরে চল। যাদব তুমি কেন শুইয়া আছ। রাখাল সারা দিন খেলা করে। তুমি দৌড়িয়া যাও কেন, পড়িয়া যাইবে। নবীন, কাল তুমি বাড়ি যাইবার সময় পথে ভুবনকে গালি দিয়াছিলে। তুমি ছেলেমানুষ, জান না কাহাকেও গালি দেওয়া, ভাল নয়। দেখ রাম, কাল তুমি পড়িবার সময় বড় গোল করিয়াছিলে।
তোমাকে বারণ করিতেছি, আর কখনও পড়িবার সময় গোল করিও না। নেহাৎ বর্ণ-অক্ষর-শব্দ-বাক্য বিন্যাস নয়, বোধের চাবিকাঠি। কবেকার সেই ফেলে-আসা, মায়াকাড়া দিনগুলোর অমোঘ অদৃশ্য বন্ধুচরিত্র যদু, তারক, ঈশান, উমেশ, মাধব, কৈলাস, গিরিশ। সন্ধের ঢুলুঢুলু চোখে মায়ের কাছে পড়া দেওয়া ‘গোপাল বড়...?’ ‘...সুবোধ।’ ‘তার বাপ মা...?’ ‘...যখন (হাই তুলে) যা বলেন, সে তাই করে।’ ‘সকল বালকেরই...?’ ‘...গো...গো...গোপালের মতো হওয়া উচিত।’ আর যে রাখালের মতো হইবে? সে লেখাপড়া শিখিতে পারিবেক না। ঠিক কবে থেকে ওই হেঁটো-ধুতি পরা, চাদর-জড়ানো, প্রশস্তভাল আইকনিক মানুষটির লেখা গোলাপি মলাটের বইখানি বাঙালির অনন্ত জীবনবোধেরও অত্যাগসহন প্রাইমার, মনে পড়ে না।


সব ছবি এঁকেছেন: সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.