পুস্তক পরিচয় ১...
মাথা উঁচু করা পুনরাবির্ভাব
টাইফুস, জাঁ-পল সার্ত্র। অনু: ক্রিস টার্নার। সিগাল বুকস, দামের উল্লেখ নেই
প্রতিরোধ্য সার্ত্র। সাহিত্যিক-দার্শনিকের গজদন্তমিনার ভেঙে বেরিয়ে এসে কখনও প্যারিসের রাস্তায় নিষিদ্ধ কাগজ ফেরি করে গ্রেফতার হচ্ছেন কিংবা সেই কাগজ সম্পাদনার দায়িত্ব নিচ্ছেন (১৯৭০), ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করছেন নোবেল পুরস্কার (১৯৬৫), আলজিরিয়া ও ভিয়েতনামের জন্য পথে নামছেন, পুলিশের গুলিতে শ্রমিকনেতা নিহত হলে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিচ্ছেন, নির্বাচনকে বলছেন ‘উজবুকদের জন্য ফাঁদ’। প্রথম যুগ থেকেই সমকালীন সংস্কৃতির আমূল প্রত্যাখ্যান ছাড়া তরুণদের কোনও গত্যন্তর নেই বলে মনে করছেন তিনি।
যিনি ব্যক্তি ও সামাজিক সংকটে অন্তহীন ভাবে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছেন, যিনি অক্লান্ত ভাবে জীবন ও জীবনভাবনাকে এক ধনুকের ছিলায় বেঁধে নিতে চেয়েছেন, এই ঠুনকো ও পিছল উত্তরাধুনিকতার ভেতর তাঁর মাথা উঁচু করা পুনরাবির্ভাব আমাদের হতচকিত করে দেয়। পঞ্চান্ন বছর পরে ১৯৪৩-’৪৪-এ লেখা জাঁ-পল সার্ত্র-এর এই হারিয়ে যাওয়া চিত্রনাট্যটি প্রকাশ করে গালিমার। এটি তার ইংরেজি অনুবাদ। ছবিটি কখনও নির্মিত না হলেও কেউ কেউ মনে করেন ১৯৫৪-য় ইভ্ আলেগ্রের একটি ছবির সঙ্গে (‘দাম্ভিকেরা’) এর মিল আছে।
‘বুর্জোয়া ফ্রান্সের অন্তহীন পচনের ভেতর, কোনও প্রকৃত বৈপ্লবিক চিন্তার অনুপস্থিতির ভেতর, সেকেলে ও মধ্যমেধার শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে’ বার বার জীবনের সত্যিকারের (authentique) প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে বেরিয়েছেন এই প্রশ্নসন্ধানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘সত্তা ও শূন্যতা’ প্রকাশের সময় থেকেই থিয়েটারে সরাসরি মানবাবস্থার ছবি মেলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। চল্লিশের দশকে উপন্যাস নিয়ে তাঁর পরীক্ষা ব্যর্থ হওয়ার পর (চার খণ্ডে পরিকল্পিত উপন্যাস ‘স্বাধীনতার রাস্তাগুলি’ তিন খণ্ডের পর পরিত্যক্ত হয়) থিয়েটারই তাঁকে চুম্বকের মতো টেনেছিল। উপন্যাস লেখার ‘ইচ্ছেই’ চলে যায় তাঁর। কারণ তা বেশি রকম সরল; কারণ মার্ক্সবাদ ও মনোসমীক্ষণের চাপে উপন্যাস ‘অদৃশ্য’ হয়ে যায়। কিন্তু থিয়েটার ‘অন্য জিনিস, তা একটি মিথ’। যেমন ব্রেশটীয় নাটক, মিথ-বিরোধী হয়েও মিথ হয়ে যায়। থিয়েটারও যে এক অর্থে এক ‘কৃত্রিম ও প্রতারক নির্মাণ’ তা তাঁর কাছে ক্রমশ পরিষ্কার হওয়ার পর সার্ত্র সাহিত্য-রচনার প্রয়াসে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের আগে নিজেকে জানার প্রয়োজনে ষাটের দশকে আত্মজীবনী ‘লে মো’ (শব্দেরা) লিখতে শুরু করেন। এবং সেটি নোবেল পুরস্কার পাওয়া মাত্র বুঝতে পারেন তাঁর অন্বেষণ ব্যর্থ হয়েছে। এ বার আর কোনও প্রাক্-নিয়ন্ত্রিত আত্মপ্রবঞ্চনা নয়, সার্ত্র নিজেকে উন্মুক্ত করবেন সাক্ষাৎকারীর প্রশ্নবাণের ছুরির ফলার সামনে।
কবিতাকে ঘৃণা করেছেন, কারণ তা ‘আবশ্যিক ভাবে মিথ্যে কথা বলে’। অথচ গান বেঁধেছেন মানুষের কাছে পৌঁছনর তাগিদে। কিন্তু তিনিই যে ‘সত্তা ও শূন্যতা’ এবং ‘মাছিরা’ প্রকাশের সময়েই চলচ্চিত্রকার পাতে-র অনুরোধে ‘তিফ্যুস’ নামে একটি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, তা প্রায় কেউই জানতেন না। অথচ একই সময়ে লেখা ‘খেলা গড়াপেটা’ চিত্রনাট্য থেকে ১৯৪৭-এ তৈরি জাঁ দ্যলানোয়া-র ছবিটির কথা অনেকেই জানেন।
কাম্যুর ‘প্লেগ’ উপন্যাসের মতো, টাইফুসের মড়ক ব্রিটিশ-শাসিত মালয়কে উজাড় করে দেওয়ার পশ্চাৎপটে এই প্রবল প্রেমের কাহিনি অস্তিত্ববাদী ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করে জনপ্রিয় পাশ্চাত্য চলচ্চিত্রের কথনশৈলীকে। কলোনিয়ালিজম ও বর্ণবৈষম্যের উপাদান এই নতুন ডিসকোর্সের খাঁজে লুকিয়ে থাকে।
“মরুভূমির দৃশ্য। রাস্তা ক্রমশ উঁচু হয়। দিগন্তে পাহাড় দেখা যায়। বাস এগিয়ে চলে, জানলা রোদে ঝলসে উঠছে।
বাসের ছাদ। মালয়বাসীর মিড-শট। তার তীব্র যন্ত্রণা। সে নিজের গা চুলকোয়, তার খিঁচুনি হয়। হাঁটু মুড়ে বসতে চায়, উপুড় হয়ে পড়ে। প্রথমে তার মাথাটা পড়ে, যার ফলে মাথাটা ছাদ পেরিয়ে গাড়ির বনেটের উপর ঝুলে থাকে।... হঠাৎ বাইরের দৃশ্য ঢেকে যায় একটি কালো, আঠালো তরলে, যা উইন্ডস্ক্রিনের ওপর গড়িয়ে পড়ে। ড্রাইভার ওয়াইপার চালু করে।
রক্তমাখা ওয়াইপারের ক্লোজ-আপ।”
নাইটক্লাবের গায়িকা নেলি, যার সঙ্গী মড়কে মারা গিয়েছে, এবং সমাজের তলপেটে তলিয়ে যাওয়া সম্মান-খোয়ানো এক চিকিৎসক। তাদের নিয়ে মৃত্যুরোল, সুররিয়্যালিস্ট রসিকতা, চিৎকার, শব্দগুঁড়ো, নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকার।
সার্ত্র পারেন, সেই সার্ত্র। ফিরে এসেছেন গত শতাব্দীর অগ্নিদগ্ধ বিবেকের সম্ভবত শেষ পশ্চিমি প্রতিনিধি। আর তাঁর তুরপুনের সামনে ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে আমাদের ক্লিন্ন জীবনের ছলছলানো মুখোশমালা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.