গানের খনি
রেকর্ড রাখছে রেকর্ডপাড়াই
র্মতলা স্ট্রিটের ট্রামলাইন ধরে ওয়েলিংটন মোড়ের দিকে এগোলে কমলালয় সেন্টারের আশেপাশে চোখে পড়বে কিছু পুরনো রেকর্ডের দোকান। যানবাহনের কর্কশ আর্তনাদ উপেক্ষা করে মাঝে মাঝেই ভেসে আসে চেনা-অচেনা বহু গানের সুর। এই সব দোকানে দেখা মেলে সারি সারি লং প্লেয়িং রেকর্ড আর পিতলের চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনের। আর মাটিতে রাখা থাকে থাকে গ্রামোফোন রেকর্ড। ধুলোমাখা রেকর্ডের স্তূপেই এক সময় মিলত গহরজান, মৈজুদ্দিন, মালকাজান অথবা গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর ডিস্ক।
পরিচিত এই ছবিটা আজ বদলেছে। ৭৮ আরপিএম গালার রেকর্ড আজ আর আগের মতো মেলে না। রেকর্ড পাড়ায় আজ আকাল। গালার কালো চাকতি-বন্দি হারানো দিনের সে সব গান আজও ছুঁয়ে যায় নস্ট্যালজিয়া। গ্রামোফোনে দম দিয়ে কালো লেবেলের সেই বিখ্যাত ‘কুকুর ও গ্রামোফোন’ মার্কা রেকর্ড চাপিয়েই শুরু হয়ে যেত গান। আর স্টাইলাসের ৭৮ স্পিডে ঘুরতে ঘুরতে মিশে যেত লেবেলের পরিচিত ছবি। ঠিক তেমনই যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের রেকর্ড-সংস্কৃতি।
ষাটের দশকে বন্ধ হয়ে যায় ৭৮ আরপিএম-এর গালার রেকর্ডের যুগ। শুরু হয় ইপি ও লং প্লেয়িং রেকর্ডের যুগ। তার পরে ২০০২-এ ভারতের রেকর্ড কালচার শতবর্ষ পেরিয়েছে। আর শতবর্ষের রেকর্ডে সঙ্গীত কেবল মাত্র বিনোদনের গণ্ডি অতিক্রম করে আজ হয়ে উঠেছে ইতিহাস। তাই পুরনো রেকর্ড আজ গবেষণা ও সংগ্রহের বিষয়।
কয়েক বছর আগেও এই ওয়েলিংটন, শিয়ালদহের চোরাবাজার বা ফ্রি স্কুল স্ট্রিট অঞ্চল রেকর্ড সংগ্রাহকদের কাছে ছিল গানের খনি। পুরনো বাড়ি থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া এই সব রেকর্ড কাবাড়িওয়ালাদের হাতে এসে পৌঁছত শিয়ালদহের চোরাবাজার, ওয়েলিংটন ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বা গোপালনগরের পুরনো রেকর্ডের দোকানে। তবে ছবিটা আজ অন্য। রেকর্ড-ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চল থেকে খুব বেশি গ্রামোফোন রেকর্ড আজ আর পাওয়া যায় না। তাই এই সব রেকর্ড পাগল সংগ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে তাঁরা পাড়ি দিচ্ছেন ভিন্ন রাজ্যে।
কী বলছেন ওয়েলিংটন ও শিয়ালদহের রেকর্ড বিক্রেতারা? রেকর্ড ব্যবসায়ী শেখ মুকতার বললেন, ‘‘কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চল থেকে এখন রেকর্ড খুব কম পাওয়া যায়। কিন্তু সংগ্রাহকেরা প্রায় প্রতি দিনই ফোন করে জানতে চান কিছু নতুন এল কি না। তাই এখানে পাওয়া না গেলেও পটনা, আগ্রা, বারাণসী, দিল্লি, মুম্বই থেকে মাঝে মাঝে রেকর্ড আনতে হয়। আর পছন্দমতো রেকর্ড পেলে সংগ্রাহকেরা ভাল দাম দিয়ে থাকেন।’’
অন্য এক রেকর্ড ব্যবসায়ী মহম্মদ ইলিয়াস জানালেন, অন্যান্য রাজ্য থেকে রেকর্ড আনার পাশাপাশি কোনও সংগ্রাহক তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ বিক্রি করলে ভাল রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ইলিয়াসের সংগ্রহে রয়েছে অসংখ্য গ্রামোফোন। যার মধ্যে বেশ কিছু মডেল আজ দুর্লভ। ইলিয়াস আরও বললেন, ‘‘এক সময় বিক্রি করেছি এডিসনের সিলিন্ডার রেকর্ড, কার্ডবোর্ডের তৈরি নিকোল রেকর্ড ও ফ্রান্সের প্যাথে রেকর্ড। কিন্তু এ সব আজ স্মৃতি।’’
শিয়ালদহ চোরাবাজারের রেকর্ড ব্যবসায়ী সুখেন্দু সরকার বললেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই রেকর্ড সংখ্যায় কম আসছে। তার উপরে পুরনো রেকর্ডের দোকানের সংখ্যাও কমছে। বেশির ভাগ সংগ্রাহক চান দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড সংগ্রহ করতে। সেগুলি কালেভদ্রে দশ বছরে একটি কি দু’টি হয়তো পাওয়া যায়। যেমন নিকোল রেকর্ডে রমজান খানের টপ্পা অথবা গ্রামোফোন কনসার্ট রেকর্ডে কালে খাঁ অথবা মহম্মদ বান্দী। অথবা ৭৮ আরপিএম রেকর্ডে বিটলস-এর ডিস্ক। এ সব আজ ইতিহাস। তবে এখনও পাওয়া যায় আঙুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া ও পঞ্চাশ-ষাট দশকের সিনেমার গান ও বেসিক ডিস্ক। তবে ভয় হয় এক দিন হয়তো রেকর্ড আসা বন্ধ হয়ে যাবে।’’
পুরনো বাংলা গানের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখায় রেকর্ড সংগ্রাহকদের বিশেষ ভুমিকা রয়েছে। সময়-অসময়ে এঁরাই বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানিকে গান দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। প্রয়াত সুরাজলাল মুখোপাধ্যায় তিলতিল করে রেকর্ড সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছিলেন প্রায় ৬০-৭০ হাজার গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহ। বর্তমানে তাঁর এই সংগ্রহ রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন তাঁর জামাতা অমিত গুহ।
রেকর্ড-সংস্কৃতির হাল হকিকত জানা গেল রেকর্ড সংগ্রাহক সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি বললেন, “কয়েক বছর আগেও দোকানে গিয়ে রেকর্ড ঘেঁটে কিছু না কিছু পেয়ে যেতাম। আজ ছবিটা বদলেছে। প্রয়োজনীয় রেকর্ড আজ খুব একটা পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও বিক্রেতারা বলেন অন্য রাজ্য থেকে আনতে হয়েছে। তাই দাম বেশি পড়বে।’’
শৈলশেখর মিত্র বললেন, ‘‘অনেক দোকান আজ আর নেই, যেখান থেকে এক সময় রেকর্ড পেতাম। তাই আগে যা সংগ্রহ করেছি সেগুলোকেই রাখার চেষ্টা করছি। নতুন রেকর্ড এখন আর পাই না।’’ অন্য দিকে হিন্দি ও বাংলা ছায়াছবির গানের রেকর্ড সংগ্রাহক অশোক ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘কলকাতার রেকর্ডপাড়ার তুলনায় দিল্লি, ইন্দৌর, রাঁচি, ও বেঙ্গালুরু থেকে প্রয়োজনীয় রেকর্ড পেয়ে থাকি।’’
তবু রোদ, ঝড় ,বৃষ্টি, উপেক্ষা করে এই সব রেকর্ড সংগ্রাহকেরা ‘ক্যালেক্টরস প্যাশন’ নিয়ে আজও ঘুরে বেড়ান কলকাতার রেকর্ডপাড়ায়। অজানা খনির নতুন মণির সন্ধানে।

ছবি: পিন্টু মণ্ডল




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.