ব্যাগ গুছিয়ে... পুজোর ছুটিতে ধনৌলটিতে
শুনশান পাহাড়ে অস্ফুটে কথা বলে শনশন হাওয়া। শুধু গাছেদের কানে কানে। কী আছে সে কথায়, কে জানে! তাতেই পুলকিত পাইনরাজি তিরতির করে কেঁপে চলে সারাক্ষণ। আর পাতার ফাঁকে সরু ডালে বসে নিশ্চুপ দোল খেয়ে যায় গোল্ডেন অরিওল।
সামনের ঢাল বেয়ে সুশৃঙ্খল দেবদারুর সঘন সমারোহ। তার পরেই অতল খাদ, যার ও পারে ডাইনে-বাঁয়ে একের পিছনে আর-এক বজ্রগম্ভীর পাহাড়শ্রেণির বর্ণময় উপস্থিতি গাঢ়, ফিকে কিংবা কালচে সবুজ পোশাকে। গায়ে সবার হালকা কুয়াশার আলোয়ান। গাড়োয়াল হিমালয়ের তুষারমণ্ডিত শিখরবৃন্দ মুখ লুকিয়েছে সেই কুয়াশায়।
ধনৌলটি পর্যটকদের সঙ্গে এখনও ততটা সখ্য গড়ে ওঠেনি স্বল্পপরিচিত, নির্মীয়মাণ এই শৈলশহরের। দু’হাত উজাড় করে প্রকৃতি সাজিয়েছে ধনৌলটিকে। আর তাকে আরও মহার্ঘ করেছে অসীম নীরবতা। ধনৌলটি ইকো-পার্কের শীর্ষস্থিত ভিউ পয়েন্টে বসে অফুরান মুগ্ধতায় সারা দিন শুধু প্রকৃতি নিরীক্ষণ করার জন্যই এখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করে অন্তত একটি রাত। বছর চারেক আগে উদ্বোধন হয় ধনৌলটি ইকো পার্কের, যেখানে গোল্ডেন অরিওল, হোয়াইট-ক্রেস্টেড লাফিং থ্র্যাশ, হোয়াইট থ্রোটেড লাফিং থ্র্যাশের মতো বিরল প্রজাতির পাখিদের দর্শন মেলে। স্বভাবতই পক্ষীপ্রেমীদেরও প্রিয় জায়গা হতে পারে ধনৌলটি।
পাহাড়ের গা বেয়ে পায়ে-চলা পথ ধরে ইকো-পার্কের শীর্ষে ওঠার সময় বিশ্রাম নেওয়ার আসন আছে, রয়েছে ছোটদের জন্য বেশ কিছু মজাদার রাইডও। অসাধারণ এই ইকো পার্কটি এখানকার অন্যতম আকর্ষণ হলেও ধনৌলটির অন্যান্য আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যগুলির মধ্যে রয়েছে শুটিং পয়েন্ট, দুর্গামন্দির, শিবশক্তি মন্দির, তপোবন, আপেল বাগান ইত্যাদি।
মুসৌরির ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে ডান দিকে বেঁকে মুসৌরি-চাম্বা রোড ধরে সোজা ২৮ কিমি গেলেই ধনৌলটি। সকালের তাজা রোদ গায়ে মেখে, ঝকঝকে প্রকৃতিকে দু’চোখ ভরে দেখে, ৪ কিমি দুদ্দাড় দৌড়ে এসে বাধাঘাটের ছোট্ট হোটেলে গরম-গরম আলুর পরোটায় ব্রেকফাস্ট সেরে, সুয়াখোলি হয়ে আমাদের গাড়ি গিয়ে থামল
আবার বুরাংস্খান্ডায়। বাঁ দিকের পাহাড়ের ঢালে ধাপচাষের সবুজ। চালক জানালেন, এখান থেকে নাকি যমুনোত্রী শৃঙ্গ পরিষ্কার দেখা যায়। দূরের পাহাড়ের ঘন কুয়াশায় আমরা তা অবশ্য দেখতে পেলাম না। তবে সেই না-পাওয়ার বেদনা দ্রুত দূর করে দিল ধনৌলটির প্রকৃতি। ধনৌলটির উচ্চতা প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট।
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ ধনৌলটিকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা শুরু কেম্পটির উদ্দেশে। মুসৌরির এক হাত যদি ধনৌলটি হয়, আর একটি হাত ১৭ কিমি দূরের কেম্পটি। দুটি শহর মুসৌরির দু’পাশে। কেম্পটির উচ্চতা প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট।
পর্যটক মহলে জনপ্রিয়তার কারণে, এ পথে গাড়ির আনাগোনা ও জনসমাগম অনেক বেশি। কার-পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজতেই বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। একটি হোটেলে চটপট লাঞ্চের অর্ডার পেশ করেই সোজা গিয়ে হাজির হলাম রোপওয়ের টিকিট কাউন্টারে। রোপওয়ের কল্যাণে নিমেষেই পৌঁছে গেলাম কেম্পটি ফল্স-এর পাদদেশে।
নিরালা ধনৌলটি থেকে গিজগিজ ভিড়ের কেম্পটিতে এসে যে-বিরক্তির সঞ্চার হয়েছিল মনে, সুবিশাল এই ফল্সের সৌন্দর্যে ও হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো তার জলকণার ছোঁয়ায় মন ভাল হয়ে গেল নিমেষে।
গাড়িতে আসার সময় বাঁ হাতে দেখেছিলাম প্রপাতটির একটি মাত্র ভাঁজ। কিন্তু কেম্পটির পাদদেশে পৌঁছে টের পেলাম তার বিশালতা। দুটি ধাপে বিভক্ত হয়ে সুবিশাল জলপ্রপাতটি সবেগে আছড়ে পড়ছে। বহু পর্যটককে দেখলাম কেম্পটির জলে স্নান সেরে নিতে। আবার প্রপাতের জলকে ঢালু পথে বইয়ে এনে, একটি কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে সেখানে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আশেপাশে বেশ কিছু ফাস্ট ফুড ও চা-কফির দোকান।
ধনৌলটি-কেম্পটি ঘুরে আবার যখন মুসৌরিতে ফিরলাম, তখন সন্ধে হয়-হয়। জমজমাট ম্যালে পর্যটকের ঢল। আর সেই ভিড়ে দিব্যি ইনসাইড-আউটসাইড ডজ করে, প্যাঁকপ্যাঁক শব্দ মনে করিয়ে দিল, আবার ফিরতে হবে কলকাতায়।

কী ভাবে যাবেন
হরিদ্বার থেকে গাড়িতে দেরাদুন, মুসৌরি হয়ে
প্রায় ১১৫ কিমি দূরে ধনৌলটি। লাগবে ঘণ্টা পাঁচেক।
কোথায় থাকবেন

নির্জন প্রকৃতির সান্নিধ্য পছন্দ করলে থাকুন ধনৌলটিতেই, হোটেল আছে
গোটা তিনেক। মুসৌরিতে থেকে ঘুরেও আসতে পারেন।
মনে রাখবেন
ওষুধপত্র, টর্চ, গরম পোশাক। দূরবিন থাকলে ভাল হয়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.