অলিম্পিকে এক চুলের জন্য ফস্কে গিয়েছে ব্রোঞ্জ। দেশে ফিরে এসে অর্জুন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। বাংলা খেলাধুলার সেই নতুন ‘আইকন’ শ্যুটার জয়দীপ কর্মকার এ বার অভিমানে বাংলা ছাড়তে চাইছেন। যা শুক্রবার জানাজানি হওয়ার পর সর্বস্তর থেকে জয়দীপকে বাংলায় রেখে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র সবাই দাঁড়াচ্ছেন জয়দীপের পাশে।
কিন্তু কেন রাজ্য ছাড়ার কথা ভাবছেন জয়দীপ? অর্জুন পুরস্কার নিতে দিল্লিতে আসা জয়দীপকে তাদের রাজ্যের হয়ে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় নামার অনুরোধ করেন হরিয়ানা সরকারের মন্ত্রী-আমলারা। জয়দীপ বলছিলেন, “ওঁরা আমাকে হরিয়ানার হয়ে জাতীয় গেমস আর সর্বভারতীয় নানা শ্যুটিং টুর্নামেন্টে নামার প্রস্তাব দিয়েছেন। এক মাস হয়ে গেল অলিম্পিক শেষ হয়েছে। আমার অফিস কর্তৃপক্ষ রেল আর অন্য সংস্থাও নানা ভাবে আমাকে স্বীকৃতি দিলেও আমার রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কিছুই করা হয়নি। আমাকে ডাকেনইনি ওঁরা। আমি নিজে থেকে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের কাছে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম আমাকে অন্য রাজ্যের মতো সাহায্য করুন। একটা জমি চেয়েছিলাম। অলিম্পিকে চতুর্থ হয়েছি। কিন্তু কিছুই তো পেলাম না।”
জয়দীপের ক্ষোভের কথা জানাজানি হওয়ার পর এ দিন সৌরভ বলেন, “জয়দীপের জন্য শ্যুটিংয়ে প্রাথমিক ভাবে যা যা দরকার, তা এ রাজ্যেও পাওয়া যেতে পারে। স্পনসরশিপের সমস্যা হলে পাশে আছি।” রাতে ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি সোমবার জয়দীপের সঙ্গে বসব। ওর কী সমস্যা তা জানার চেষ্টা করব।” ক্রীড়ামন্ত্রী বলে রেখেছেন, তাঁরা জয়দীপের জন্য স্পনসরের খোঁজ করবেন। “বাংলার মানুষ জয়দীপকে প্রচুর সম্মান দিয়েছে। আশা করব, ও বাংলা ছেড়ে যাবে না,” বলেছেন মদনবাবু। |
জয়দীপের ক্ষোভের কথা ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন মহলে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা তিরন্দাজ দোলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “খবরটায় অবাক হওয়ার কিছু দেখছি না। আমিও অন্য রাজ্যে চলে গিয়েছিলাম। একটাই কারণে, তিরন্দাজিতে ভাল কিছু করতে যে ধরনের সাহায্য দরকার সেটা টাটা সংস্থা থেকে পেয়েছিলাম। জয়দীপও হয়তো ভাল পরিকাঠামো পাচ্ছে হরিয়ানায়।” বাংলার আর এক তারকা অ্যাথলিট জ্যোতির্ময়ী শিকদার এর আগে এক বার বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর মন্তব্য, “অলিম্পিকে পদক আনতে পারে এমন এক জন শ্যুটারকে কেন অন্য রাজ্যে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে? নিশ্চয়ই এ রাজ্যে পরিকাঠামো নেই বলেই। শ্যুটিং রেঞ্জ করতে তো একটুখানি জমি লাগে। যে রাজ্য সরকার এত কিছু করবে বলছে, তারা দায়িত্ব নিয়ে এটুকু করে দিচ্ছে না কেন?”
তবে লন্ডন অলিম্পিক ফেরত ভারতেরই আর এক শ্যুটার রঞ্জন সোধী একটু অবাক জয়দীপের কথা শুনে। তাঁর কথায়, “কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক পরের রিও অলিম্পিক পর্যন্ত ২২ জন শ্যুটারের ট্রেনিংয়ের যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেবে। আমার মনে হয় না ট্রেনিংজনিত কোনও সমস্যা জয়দীপের হচ্ছে বলে।” অলিম্পিকে ভারতকে ব্রোঞ্জ এনে দেওয়া মহিলা বক্সার মেরি কম আবার মনে করেন, রাজ্য সরকার যদি পাশে না দাঁড়ায়, তা হলে যে কেউ রাজ্য ছেড়ে যেতেই পারেন। তিনি বলেন, “রাজ্যের কাজ হচ্ছে ক্রীড়াবিদদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের মানসিক ভাবে উজ্জীবিত করা। না হলে সে কেন থাকবে? হরিয়ানা সরকার শুধু পদকজয়ীদের নয়, যারা অলিম্পিকে গিয়েছিল, তাদেরও অনেক ভাবে সাহায্য করছে।” তাদের রাজ্য থেকে অলিম্পিকে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেছেন, হরিয়ানা সরকার তাঁদের প্রত্যেককে ১১ লাখ টাকা পুরস্কার দিয়েছে। সঙ্গে দামি গাড়ি। মণিপুর, মিজোরামের মতো ছোট রাজ্যও অলিম্পিয়ানদের ২৫ লাখ টাকা দিয়েছে। সেখানে জয়দীপের ভাগ্যে জুটেছে এখন পর্যন্ত শুধু দু’লাখ টাকা। নাগেরবাজার অমরপল্লীর অভিমানী শ্যুটার বলছিলেন, “আমার থাকার জায়গা নেই। বাবার ফ্ল্যাটে থাকি। যা টাকা পাই সব রাইফেল, গুলি কিনতে আর প্র্যাক্টিসে খরচ হয়ে যায়। গত বছরও বাংলার হয়ে জাতীয় গেমসে সবথেকে বেশি পদক জিতেছি আমি। তা হলে কেন স্বীকৃতি পাব না?”
বাংলা ছাড়ার ব্যাপারে এখনও অবশ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি জয়দীপ। তবে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো পরিষ্কার হয়ে যাবে বাংলা তার এক উজ্জ্বল ভূমিপুত্রকে হারায় কি না। |