বছর ঘুরল
গতিই সম্বল
শুধু পরিবর্তন নয়, এ যেন রাতারাতি বদলে যাওয়া এক শহর!
যে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন দাঁড়িয়ে থাকে রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড বা হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড। দিনরাত সেখানে আদানপ্রদান হয় এলাকার খবরাখবর। ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি যানশাসন করেন নীল গেঞ্জি, কালো প্যান্ট পরা কিছু যুবক। যাঁদের পোশাকি নাম ‘সিভিক পুলিশ’। রাস্তার মোড়ে লাগানো কোনও গোপন ক্যামেরা নিরন্তর ধরে রাখে পথচলতি মানুষ ও যানবাহনের ছবি। কোথাও আবার ধরপাকড় চলে দীর্ঘ দিন ধরে ট্রাফিক আইন মেনে না চলা যানচালকদের। যে পথ পেরোতে আগে লাগত অন্তত দেড় ঘণ্টা, সেই পথই এখন অনায়াসে যাওয়া যায় আধ ঘণ্টায়।
পুলিশ কমিশনারেট হওয়ার পরে গত এক বছরে এটাই হল হাওড়ায় বেবাক পাল্টে যাওয়া নগরজীবনের ছবি।
আজ, শনিবার সেই পুলিশ কমিশনারেটের জন্মদিন।
রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নেন, কিছু জেলার আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে তৈরি করা হবে পুলিশ কমিশনারেট। সেই মতোই হাওড়া জেলা পুলিশ থেকে তৈরি হয় হাওড়া সিটি পুলিশ। শহরাঞ্চলের আটটি থানাকে নিয়ে তৈরি এই কমিশনারেটে প্রথম পুলিশ কমিশনার (সিপি) হিসেবে দায়িত্ব নেন অজেয় মুকুন্দ রানাডে। একই সঙ্গে হাওড়ায় আসেন এক ঝাঁক তরুণ পদস্থ কর্তা। প্রথম দিনই অজেয় রানাডে জানিয়েছিলেন, তাঁদের মূল লক্ষ্যই হবে, মানুষের কাছে অতি দ্রুত পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া, ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া।
হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রে খবর, পুলিশ কমিশনারেটে কমিশনার ছাড়াও রয়েছেন দু’জন ডেপুটি কমিশনার। যাঁদের এক জন আছেন সদরের দায়িত্বে। অন্য জনকে একই সঙ্গে ট্রাফিক ও গোয়েন্দা দফতর সামলাতে হয়। আটটি থানার মধ্যে বালি, মালিপাঁচঘড়া, লিলুয়া ও গোলাবাড়ি এই চারটি থানা নিয়ে তৈরি হয়েছে উত্তর জোন এবং হাওড়া, জগাছা, ব্যাঁটরা ও শিবপুর নিয়ে দক্ষিণ জোন। দু’টি জোনের দায়িত্বে রয়েছেন দু’জন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (এডিসি)। এ ছাড়াও রয়েছেন ১০ জন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এসি)।
ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে আটটি থানা এলাকায় ছ’টি ট্রাফিক গার্ড বা ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। যার অধীনে রয়েছে ১৩টি সাব ট্রাফিক গার্ড। আবার এলাকায় অসামাজিক কাজকর্ম বন্ধ ও খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তৈরি করা হয়েছে নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ। যানবাহনের বিষয়ে দেখভালের জন্য আলাদা একটি ট্রাফিক দফতরও তৈরি হয়েছে। দু’টির জন্যই বেলিলিয়াস রোডে একটি আলাদা অফিসও তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, আটটি থানা এলাকায় থানার টহলদারি গাড়ির পাশাপাশি দিনে ও রাতে ভাগ করে টহল দেয় ছ’টি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড ও হাই রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াডের গাড়ি। অফিসার, কনস্টেবল মিলিয়ে পুলিশ কর্মীর সংখ্যা আড়াই হাজার।
হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী হাওড়ায় কমিশনারেট ঘোষণা করার পরেই পুলিশকে প্রথমেই দু’টি বিষয় দেখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমত, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি এবং দ্বিতীয়ত হাওড়ার যানজট কমানো। সিটি পুলিশের দাবি, ওই দু’টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে কমিশনারেটের শুরুতেই হাওড়ায় যান চলাচলের সামগ্রিক ছবিটাই বদলে দেওয়া হয়। পুলিশের এই দাবি যে যথাযথ তার প্রমাণ মেলে হাওড়া শহরাঞ্চলের রাস্তায়।
হাওড়া সিটি পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে খবর, গত এক বছরে ট্রাফিকের উন্নয়নে একগুচ্ছ কাজ করা হয়েছে। যেমন, হাওড়া স্টেশন এলাকায় বেআইনি পার্কিং বন্ধ করা, রাস্তার ধারে যত্রতত্র পার্কিং সরানো, রাস্তায় একমুখী ব্যবস্থা চালু করা, রাস্তায় বালি, সিমেন্ট, স্টোনচিপস ফেললে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের। ট্রাফিক আইন না মানায় গত এক বছরে ২ লক্ষ ১২ হাজার ৬০০ জন চালককে কেস দেওয়া হয়েছে। ৭ কোটি ৮৮ লক্ষ ৬৯ হাজার ৯৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তার মধ্যে আদায় হয়েছে ৬ কোটি ১৮ লক্ষ ৮৩ হাজার ৫৫০ টাকা। অথচ, আগে গোটা জেলায় বছরে ট্রাফিক থেকে আয় হত গড়ে ২২ থেকে ২৬ লক্ষ টাকা। উল্লেখ্য, পুলিশকর্মীদের ক্ষেত্রেও ট্রাফিক আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, মহিলাদের সুবিধার্থে হাওড়া ওল্ড কালেক্টর বিল্ডিংয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি মহিলা থানা। এক পুলিশকর্তা বলেন, “কোনও নির্যাতিতা মহিলা যদি থানায় যেতে ভয় বা লজ্জা পান তবে তিনি এখানে এসে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। এমনকী, মহিলা সংক্রান্ত কোনও ঘটনায় মহিলা থানাও স্থানীয় থানার পাশাপাশি তদন্ত করতে পারবে।”
প্রতিটি থানার সঙ্গে সদর দফতরের অফিসার ও পুলিশকর্তাদের সরাসরি যোগাযোগের জন্য পুলিশ কমিশনারেট অফিসেই তৈরি হয়েছে কম্পিউটার চালিত উন্নতমানের কন্ট্রোল রুম।
আবার প্রতিটি থানায় ও থানা এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে, রাস্তায় নজরদারি চালানোর জন্য লাগানো হয়েছে সিসিটিভি। কোনও ঘটনা ঘটলে কয়েক দিন পর্যন্ত সেই ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যাবে সংশ্লিষ্ট থানার সিসিটিভি সার্ভার থেকে। আবার থানায় বসেই এডিসি এবং এসি-রা মানুষের কথা, অভিযোগ শুনছেন। পুলিশের এক কর্তার কথায়, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের কাছে আরও সহজে পৌঁছনোর জন্য তৈরি করা হয়েছে হাওড়া সিটি পুলিশের নিজস্ব ওয়েবসাইট।
কিন্তু এত কিছু ‘ভাল’র মধ্যেও কিছু ‘মন্দ’ রয়েছে। যেমন, জগাছার ধর্ষণ কাণ্ড, বালিতে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের মতো ঘটনা। এ ছাড়াও প্রকাশ্য রাস্তায় খুন, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও কমিশনারেটের আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কমিশনারেটের ওয়েবসাইটেরই তথ্য বলছে, এক বছরে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণের ঘটনা কতটা বেড়েছে। যদিও পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডে এটাকে অবনতি বলে মানতে রাজি নন। তাঁর কথায়: “আগেও এমন ঘটনা ঘটত। কিন্তু মানুষ থানায় এসে অভিযোগ করতেন না। এখন সেই সংখ্যা বেড়েছে বলেই অপরাধ বেশি ঘটছে বলে মনে হচ্ছে।” তবে তিনি জানান, পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য আরও পাঁচশো অফিসার এবং এক হাজার কনস্টেবল নিয়োগ করা হবে। আরও চারটি নতুন থানাও (সাঁতরাগাছি, দাশনগর, বেলুড়, নিশ্চিন্দা) তৈরি করা হচ্ছে।

হাওড়া কমিশনারেটে
অপরাধের পরিসংখ্যান
১ সেপ্টেম্বর ’১১—২৯ অগস্ট ’১২
অপরাধ সংখ্যা
নকল টাকা উদ্ধার
দেহব্যবসা ও শিশু শ্রমিক
ডাকাতি
খুন
ধর্ষণ
নারীঘটিত অপরাধ
ইভটিজিং
সূত্র: হাওড়া সিটি পুলিশ
ছবি: রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.