|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
তাঁর প্রতিবাদ সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধেই |
সিগাল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল জি রেঘুর একক প্রদর্শনী। ঘুরে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সিগাল-এর নিজস্ব গ্যালারিতে দক্ষিণ ভারতের বিশিষ্ট ভাস্কর জি. রেঘুর ভাস্কর্যের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। কাচের দরজা ঠেলে প্রদর্শনীকক্ষে প্রবেশ করলে নিয়ন্ত্রিত শীতলতায় আমরা অসামান্য এক শান্ততা অনুভব করি। স্তব্ধতা মিশে থাকে সেই শান্ততার সঙ্গে। সিরামিকসে তৈরি অজস্র মানব-মানবী ও অন্যান্য প্রাণীর অবয়ব নিয়ে এই প্রদর্শনী। সেই অবয়বের সমগ্র গঠনের মধ্যে এক ধরনের শান্ততা বা শীতলতা তো আছেই। কিন্তু সেটা ততটা অনুভবগম্য হত না, যদি না অবয়বগুলিকে গ্যালারির নির্দিষ্ট বিন্যাসের মধ্যে দেখা যেত। বিন্যাস ও আঁধার-জড়ানো নিয়ন্ত্রিত আলো এই রচনাগুলিতে স্বতন্ত্র এক প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। সেই প্রাণে স্তব্ধতা আছে। আত্মসমাহিতি আছে। বাইরের সমস্ত কোলাহলকে, দম্ভ ও আত্মপ্রচারকে যা নিবারণ করতে চায়। অস্তিত্বের অন্তর্গত ধ্যানমগ্নতার এক আবহ গড়ে তোলে। মাটির কাছাকাছি আমাদের যে জীবনধারা সেখানে এখনও হয়তো এই সমাহিতির কিছু অবশেষ রয়ে গেছে। রেঘু সম্ভবত তাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁর ভাস্কর্যে। এ ভাবে তিনি তাঁর শিল্পের মধ্য দিয়ে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন একই সঙ্গে। এই যে ভাঙনের, কোলাহলের, অহমিকার উতরোল হাওয়ায় বিশ্লিষ্ট হয়ে যাচ্ছে সারা দেশ, তার বিপরীত প্রান্তের এক আলেখ্য তুলে ধরতে চেয়েছেন। এর মধ্যে সুপ্ত আছে বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ। অন্য দিকে তিনি উদ্ভাসিত করতে চেয়েছেন সাম্প্রতিক ভাস্কর্যের এক দেশীয় আত্মপরিচয়। ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত আমাদের ভাস্কর্যের একটা সমস্যা ছিল আঙ্গিকে অতিরিক্ত পাশ্চাত্য-মুখীনতা। বিকল্পের সন্ধানও অবশ্য পাশাপাশি চলেছে। মীরা মুখোপাধ্যায় বা দক্ষিণ-ভারতের কানহাই কুনহিরামন প্রমুখ ভাস্করের কাজে যেমন। ১৯৯০-এর দশক থেকে তরুণ ভাস্করদের অনেকেই চেষ্টা করেছেন রূপভঙ্গির সঙ্গে ঐতিহ্যের সংযোগ ঘটাতে। রেঘুর কাজে সে রকম স্বদেশসম্পৃক্ত আন্তর্জাতিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। দক্ষিণ-ভারতের সাধারণ মানুষ তাঁর ভাস্কর্যের বিষয়। আঙ্গিকেও তিনি চেষ্টা করেছেন সেখানকার অনুরণনকে প্রকাশ করতে।
|
|
শিল্পী: জি. রেঘু |
জি. রেঘুর জন্ম ১৯৫৯ সালে কেরলের কিলিমানুরে। ত্রিবান্দ্রমের কলেজ অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি ভাস্কর্যে স্নাতক হয়েছেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ভূপালের ভারত ভবনে এক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যোগ দেন। সেখানে এস.এইচ.রাজা, হুসেন ও জে. স্বামীনাথনের কাছে তাঁর শেখার সুযোগ হয়। তাই দক্ষিণ-ভারতীয় পরিমণ্ডল ছাড়াও এই উৎস থেকে ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর দায়বোধ জেগে ওঠে।
কাঠ, পাথর, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে মাটিই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রিয় মাধ্যম। প্রদর্শনীর স্মারকপত্রে মুদ্রিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে তিনি কাজ করেছেন মৃত্তিকা রূপান্তরিত সিরামিক নিয়ে। সিরামিক আছে দুই রকম। পোর্সিলিন ও স্টোনওয়ার। পোর্সিলিন সাধারণত ব্যবহৃত হয় পটারির জন্য। আর স্টোনওয়ার হল ভাস্কর্যের মাধ্যম। তিনি বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি স্টোনওয়ারই ব্যবহার করেন। অনেক দিন ধরে কাজ করছেন এই মাধ্যমে। ফলে এর সঙ্গে তাঁর এক আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
মৃত্তিকার কিছুটা পুরু চাদর বানিয়ে তাকে ভাঁজ করে বা জড়িয়ে তিনি গড়ে তোলেন অবয়ব। সেই অবয়ব গ্রামীণ মানব-মানবী-শিশুর। পশুও গড়েন নানা রকম বিশেষত গো-জাতীয়। অবয়বের এই এককগুলিকে যূথবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর এক একটি রচনা। অজস্র পুরুষ ও নারী গোল হয়ে বসে আছে বিশেষ এক পরিমণ্ডলে। তাঁদের সকলের অভিব্যক্তিতে রয়েছে শান্ততা। সমগ্র রচনার উপর খুব সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে আলোকসম্পাত করা হয়েছে। আলোছায়ার সেই পরিমণ্ডলে প্রশান্তি এক মরমি রূপ পেয়েছে। এই সব মানুষের জীবনে দুঃখ আছে, অভাব আছে। তাঁরা সেগুলিকে আত্মস্থ করে নির্লিপ্ত প্রশান্তিতে তাঁদের সমবেত অস্তিত্বকে মেলে ধরছে। দু’টি কেদারার উপর পরস্পরের দিকে পিছন ফিরে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে দু’জন মানুষ পরম তৃপ্তিতে ধূমপান করছে। অজস্র গরু চরছে যেন মাঠের ভিতর। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। তাদের ঘিরে বা তাদের মাঝে বসে আছে রাখাল বা কৃষক-শ্রেণির মানুষ। স্তব্ধতা তাঁদের মধ্যেও। সেই স্তব্ধতায় আত্মমগ্ন আনন্দের বোধ আছে। আমাদের গ্রামীণ জীবনধারা থেকে এই আত্মমগ্ন প্রশান্ত আনন্দের বোধকেই তুলে এনেছেন এই শিল্পী তাঁর কাজের মধ্যে। চারপাশে বিনষ্টি, হিংসা ও ঔদ্ধত্যের কোলাহল ভেদ করে গ্রামীণ ভারতবর্ষের এক বিকল্প রূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর রচনায়। |
|
|
|
|
|