স্বাস্থ্য পরিকল্পনার ছিদ্র ঢাকতে
‘রোগচিত্র’ তৈরি হচ্ছে রাজ্যে
যেন অন্ধের হস্তিদর্শন!
বছরের কোন সময়ে, রাজ্যের কোথায়, কোন রোগ, কোন জনগোষ্ঠীর মানুষকে আক্রমণ করছে তার কোনও তথ্যই নেই। অথচ সেই রোগ প্রতিরোধ নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলছে স্বাস্থ্য দফতর কিংবা পুরসভা। ফল যা হওয়ার হয়েছে। প্রতি বছর ঘুরে ফিরে আসছে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া। রোগ ছড়িয়ে পড়ার পরে বোঝা যাচ্ছে প্রতিরোধ কর্মসূচির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই ছিল না!
যে কোনও স্বাস্থ্য পরিকল্পনা তৈরির আগে প্রতিটি পুর ওয়ার্ড, গ্রামের ‘রোগচিত্র’ তৈরির সুপারিশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। স্বাস্থ্য পরিষেবার এই ‘বর্ণপরিচয়’টাই জানা নেই এ রাজ্যের তো বটেই, এ দেশের স্বাস্থ্যকর্তাদেরও। তাই কখনও চিকুনগুনিয়া, কখনও কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া অথবা যক্ষ্মার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে দিশেহারা হয়ে পড়েন তাঁরা।
বার বার বিভিন্ন রোগ সংক্রমণের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর ‘হু’-র প্রদর্শিত পথই বেছে নিতে চলেছে। নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্যচিত্র তৈরি করতে চলেছে তারা। দেশকে এ ব্যাপারে দিশা দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গই।
বছরের পর বছর নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের উপরে এই ধারাবাহিক সমীক্ষার পোশাকি নাম ‘হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্র্যাফিক সারভাইল্যান্স’। প্রতিটি বাড়ি ধরে, পরিবার ধরে সমীক্ষা করা হয়। তাই এই ধরনের গবেষণার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পপুলেশন ল্যাবরেটরি’। সমীক্ষার আওতায় যত বেশি মানুষকে আনা যাবে, তত ত্রুটিহীন হবে স্বাস্থ্য পরিকল্পনা।
স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে বীরভূম জেলার চারটি ব্লক নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘সোসাইটি ফর হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রা্যফিক সারভাইল্যান্স’। যেখানে শিক্ষা, পুষ্টি, আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে রোগ সংক্রান্ত গবেষণা চলছে। সারা পৃথিবীতে এমন ৩৮টি পপুলেশন ল্যাবরেটরি রয়েছে। ভারতে এটিই প্রথম।
২০০৮ সালে রাজ্যের তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব সমর ঘোষের (বর্তমান মুখ্যসচিব) পরিকল্পনায় এই প্রকল্প শুরু হয়। বীরভূম জেলায় চারটি ব্লকের ৩৩৩টি গ্রামের ১৩ হাজার পরিবারের ৫৯ হাজার মানুষকে এর আওতায় এনে চালু হয় বীরভূম পপুলেশন প্রজেক্ট। মাঝখানে বহু দিন কাজ থমকে থাকার পর ফের প্রকল্পটি শুরু হয়েছে। এখন এর পরিচালন সমিতির সভানেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান বর্তমান স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং পরিচালন সমিতির সদস্য হলেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী।
শুরুটা কোথায়
পাঁচের দশকে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে ফ্র্যামিংহাম শহরে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের উপরে
সমীক্ষা চালিয়ে প্রথম জানা যায় হার্ট অ্যাটাক বা রক্তচাপ বৃদ্ধির সঙ্গে কোলেস্টেরল আর
ধূমপানের সম্পর্কের কথা। গবেষকরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বছরের পর বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ
করেছিলেন। এখন ৩৮টি দেশে এমন গবেষণা চালু রয়েছে। আছে বাংলাদেশেও। যা
জানিয়ে দিচ্ছে অশিক্ষা ও কুসংস্কারের সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে
মায়ের মৃত্যু ও নবজাতকের অপুষ্টি।
এই প্রকল্পের সহযোগী কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, অস্ট্রেলিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং কল্যাণীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিকস।
কেন বীরভূমকেই এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হল? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, বীরভূমের ওই চারটি ব্লকে গোটা রাজ্যের বৈচিত্র্যকেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। যেমন, সাঁইথিয়া মূলত কৃষিজীবীদের এলাকা, রাজনগরে গরিব আদিবাসীদের বাস, যাঁদের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেকটাই অধরা, মহম্মদবাজারে পাথর খাদানের শ্রমিকরা থাকেন। দারিদ্র আর অশিক্ষা সেখানে নিত্যসঙ্গী। বিপরীতে রয়েছে সিউড়ি, যেখানে তুলনামূলক ভাবে আর্থিক স্বচ্ছলদের বসবাস।
কী ভাবে চলছে এই গবেষণা? রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রথাগত ল্যাবরেটরি তো গড়া হয়েছেই, পাশাপাশি চারটি ব্লককে ৪০টি ক্লাস্টারে ভাগ করে সেখানে প্রশিক্ষিত সমীক্ষকদের পাঠানো হচ্ছে। তাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিয়মিত স্বাস্থ্যের হাল-হকিকত খতিয়ে দেখছেন।
কী ধরনের তথ্য মিলছে সমীক্ষায়? দলের এক সদস্য বলেন, “দাবি করা হয়েছিল বীরভূমে নাকি ‘নির্মল গ্রাম আন্দোলন’ সফল। অর্থাৎ গ্রামের ১০০ শতাংশ মানুষ শৌচাগার ব্যবহার করেন। আমাদের সমীক্ষায় কিন্তু ধরা পড়ল এখনও চারটি ব্লকের ৭৮ শতাংশ মানুষ মাঠে প্রাতঃকৃত্য সারেন! অর্থাৎ ‘নির্মলতা’ থেকে এখনও বহু যোজন দূরে আমরা।”
ওই সদস্যের মতে, স্বাস্থ্য যে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়, চারপাশের পরিবেশ, বেঁচে থাকার ধরনের উপরেই যে কোনও অসুখের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে, সেই ধারণাটাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিতে এলাকা ও জনগোষ্ঠী ভিত্তিক সমীক্ষার প্রয়োজন। সেই সমীক্ষায় কে, কোন রোগে ভুগছেন, কার ক’টি সন্তান, পরিবারে কেউ মারণ রোগে আক্রান্ত কি না, সে সব তথ্য জানা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই কার কত জমি আছে, কে কত দূর পড়াশোনা করেছেন, পানীয় জলের উৎস কী, এক মাসে বাজার খরচ কত, বাড়ি থেকে স্কুল বা ওষুধের দোকান কত দূরে, বাজারে ঋণ রয়েছে কি না, জ্বালানি হিসেবে কী ব্যবহার হয়, কোন জলে বাসন মাজা হয়, সে সবও জানা দরকার। কারণ, এই সব কিছুর যোগফলেই এক জন মানুষের জীবন। সেই জীবনেরই প্রতিফলন তাঁর স্বাস্থ্যে।
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায় “সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য কার কাছে যান, প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নাকি হাতুড়ে, প্রসব কোথায় বেশি হচ্ছে, তাঁরা হাসপাতালে পৌঁছচ্ছেন কী ভাবে, মূলত কোন রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি, ধূমপানের অভ্যাস কেমন, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে কত শতাংশের, মহিলাদের মধ্যে কত জনের রক্তাল্পতা রয়েছে, গর্ভপাতের অনুপাত কেমন, ইত্যাদি সমস্ত তথ্যই সমীক্ষকের কাছে মজুত থাকছে। এর উপরে ভিত্তি করেই ভবিষ্যতে তৈরি হতে পারবে স্বাস্থ্যনীতি।”
সমীক্ষক দলের এক পরিচালক বলেন, “এক বার পাথর খাদান অঞ্চলে সমীক্ষায় গিয়ে দেখা গেল গোটা একটা গ্রাম অদৃশ্য। খাদান মালিকের সঙ্গে বিবাদের জেরে সবাই অন্যত্র চলে গিয়েছেন। মাস কয়েক পরে তাঁরা যখন ফিরলেন, তখন তাঁদের স্বাস্থ্যের হাল ফের খতিয়ে দেখা হল। দেখা গেল, বেশ কিছু জায়গায় অবনতি হয়েছে। তুলনামূলক রিপোর্টটা এ ক্ষেত্রে সম্ভব হল, আগে সমীক্ষা হয়েছিল বলেই।”
প্রশ্ন হল, এই সমীক্ষায় আদৌ কতটা লাভ হবে, যদি না সরকারি তরফে সত্য গোপনের প্রবণতা কমে? কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, “সাম্প্রতিক ডেঙ্গি পরিস্থিতিতে আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখানোর জন্য তো স্বাস্থ্য দফতর ও পুরসভা উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে কোনও এলাকায় বিশেষ কোনও রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সেটা মেনে নিয়ে তার প্রতিকারের চেষ্টা হবে, এমন আশা করা শক্ত।” স্বাস্থকর্তারা অবশ্য এই অভিযোগকে আমল দিতে চাননি। তাঁদের বক্তব্য, সত্য গোপনের ইচ্ছা থাকলে এমন একটা প্রকল্প হাতেই নিত না সরকার। ধাপে ধাপে অন্যান্য জেলায় কাজ শুরু করে আগামী পাঁচ বছরে এই প্রকল্প যে চেহারা নেবে, তা গোটা দেশকে দিশা দেখাবে বলেই তাঁর আশা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও গবেষণার ফল হাতেনাতে পাওয়া যায় না। সোনা ফলতে সময় লাগে। এক বার তা ফললে বাঁচে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.