‘সন্ত্রাসে’র মোকাবিলা করে পঞ্চায়েত ভোটে লড়তে তারা কতটা প্রস্তুত? জেলাগুলি থেকে এই রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে আলিমুদ্দিন। ‘ঝুঁকি’ নিয়ে বামেরা সব আসনে লড়তে চেষ্টা করবে? নাকি, ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ তুলে ‘সংঘাত’ এড়িয়ে পঞ্চায়েতের ভোটকে ব্যবহার করবে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি হিসাবে? জেলা থেকে এ প্রশ্নের জবাবের পরেই পঞ্চায়েত ভোটের চূড়ান্ত রণকৌশল ঠিক করবে সিপিএম।
আগামী ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর আলিমুদ্দিনে বসছে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বর্ধিত বৈঠক। ওই বৈঠকেই প্রতিটি জেলা নেতৃত্ব আলিমুদ্দিনকে রিপোর্ট দেবে। তার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বিমান বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-সূর্যকান্ত মিশ্ররা। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটেরও ওই বৈঠকে উপস্থিতি থাকার কথা।
বাম-জমানায় প্রতিটি পঞ্চায়েত ভোটেই কংগ্রেস ও তৃণমূল ‘সন্ত্রাসে’র অভিযোগ তুলে বহু আসনে প্রার্থী দিত না। ফলে ভোটের আগেই হাজার হাজার আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিপিএম জিতে যেত। তৃণমূল-জোট ক্ষমতায় আসার পরে পরিস্থিতি ঠিক উল্টে গিয়েছে। সিপিএমের তাবড় নেতাদের মুখে ‘সন্ত্রাসে’র অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গের আটটি জেলায় ‘সন্ত্রাসে’র অভিযোগ বেশি। দুই ২৪ পরগনা, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, ও বাঁকুড়া। এর মধ্যে ছ’টি জেলা পরিষদ বামেদের দখলে। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলাতে ‘সন্ত্রাসে’র অভিযোগ তুলছে সিপিএম। সেখানেও জেলা পরিষদ বামেদের দখলে।
গ্রামের দখল কায়েম রাখতে হলে জেলা পরিষদ থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত, সব আসনেই বামেদের প্রার্থী দিতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যে যথেষ্ট প্রতিকূল তা স্বীকার করছেন সিপিএম নেতারা। বর্ধমানের অমল হালদার, বাঁকুড়ার অমিয় পাত্র, হুগলির সুদর্শন রায়চৌধুরী, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুজন চক্রবর্তী, উত্তর ২৪ পরগনার অমিতাভ নন্দী বা পূর্ব মেদিনীপুরের নিরঞ্জন সিহি প্রত্যেকেই মনে করেন, গত এক বছরে গ্রামে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমলেও সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো ‘ক্ষমতা’ অর্জন করতে পারেনি সিপিএম। উত্তরবঙ্গের অন্যতম নেতা অশোক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ-সহ কয়েকটি জায়গায় ‘সন্ত্রাসে’র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেখানে প্রার্থী দেওয়া কঠিন। এই অবস্থায় সিপিএমের রণকৌশল
কী হবে?
বর্ধমানের মতো একদা লালদূর্গেও জেলা নেতৃত্বকে পঞ্চায়েতের আসনগুলিকে তিন ভাগে চিহ্নিত করতে হয়েছে। এক, যে আসনগুলিতে অবাধ নির্বাচন সম্ভব। দুই, ‘সন্ত্রাস’ উপেক্ষা করে যে সব আসনে লড়াই করা সম্ভব। তিন, সন্ত্রাস উপেক্ষা করে যে আসনগুলিতে প্রার্থী দিতে গেলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনিবার্য। তৃতীয় ক্ষেত্রে প্রার্থী দেওয়া উচিত হবে কিনা, তা নিয়ে রাজ্য নেতৃত্ব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে অমলবাবু জানিয়েছেন। একই পরিস্থিতি পূর্ব মেদিনীপুরেও। সম্প্রতি কাঁথি বার লাইব্রেরি নির্বাচনে বাম প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে, তা উল্লেখ করেও জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি নিরঞ্জন সিহি বলেন, “কিন্তু এই সন্ত্রাসের পরিবেশে সব আসনে প্রার্থী দেওয়া কঠিন।” জেলা নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসন বামেদের অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী, সাংসদ-বিধায়কদের কথায় চলছেন। ফলে ভোটের সময়ে ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে অভিযোগ জানালেও বিশেষ ফল হবে না।
‘সন্ত্রাস’ উপেক্ষা করে সংঘাতে গেলে রক্তক্ষয় হতে পারে এই আশঙ্কা করছেন অনেক নেতাই। তাঁদের মতে, পঞ্চায়েত ভোটে ঝুঁকি না নিয়ে বরং লোকসভা ভোটের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ভাল। কারণ, তখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হবে। কিন্তু এ যুক্তি শেষ পর্যন্ত আলিমুদ্দিন মানবে কিনা, তা নিয়ে জেলা নেতৃত্ব সংশয়ে রয়েছেন।
উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় কিছুটা ভাল হলেও অশোকবাবু বলেন, “বামেরা জেলা পরিষদ জিতলেও তৃণমূল সরকার কাজ করতে দেবে না। গত এক বছরের অভিজ্ঞতায় তা প্রমাণিত। সেক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ভোটের রণ-কৌশল কী হবে তা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে ঠিক করতে হবে।” ‘সন্ত্রাসের’ যুক্তি দেখিয়ে সিপিএম যদি লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে দেয়, তা হলে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন জেলা তথা রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ। তাঁদের মতে, গত বিধানসভা নির্বাচনে যে দু’কোটি মানুষ বামেদের ভোট দিয়েছিল, তাদের কথা ভেবেই ‘সন্ত্রাসে’র ঝুঁকি নিয়েও সব আসনে লড়াই করা উচিত। এই নেতাদের মতে, ‘সন্ত্রাসে’র কারণে দার্জিলিং-এ জিটিএ ভোটে সব প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া পাহাড়েরই বহু মানুষ মেনে নিতে পারেননি। |