|
|
|
|
বিভাজন নীতিকে কটাক্ষ অধীরদের |
আমন্ত্রণ-বিতর্কের মধ্যে মাইক-বিভ্রাটে মুখ্যমন্ত্রী |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
অদ্ভুত সমাপতন কংগ্রেসের ‘শক্ত ঘাঁটি’তেই !
বহরমপুরের সাংসদ তথা দলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি অধীর চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ওই জেলা থেকেই কংগ্রেসের তিন জন জনপ্রতিনিধিকে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। তিন জনের কেউই বুধবার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাননি। মুখ্যমন্ত্রীর ‘বিভাজনের নীতি’কে তীব্র কটাক্ষ করেছেন অধীরও। আর এই বিতর্কের আবহেই বহরমপুরের ব্যারাক ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাবেশে ঘটল মাইক-বিভ্রাট!
ভিড়ে ভেঙে-পড়া ময়দানে সভা শুরুর মিনিট পনেরোর মধ্যেই মাইক-বিভ্রাটের নেপথ্যে ‘চক্রান্ত’ দেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আচমকাই মাইক বিকল হয়ে যাওয়ায় তিনি বলে ওঠেন, “কে তার ছিঁড়ল?” তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “হয়তো ভিড়ের চাপেই তার ছিঁড়ে গিয়েছে।” এর পরেই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “যাঁরা কাজ না-করে শুধু নিন্দা করেন, কুৎসা রটিয়ে চলেন, সেই সব নিন্দুকদের বলি, আপনারা সিন্দুকে থাকুন! কাজ না-করলে সরে পড়ুন!” রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, সিপিএমের
সঙ্গে সঙ্গেই মুর্শিদাবাদে মুখ্যমন্ত্রীর এমন কটাক্ষের লক্ষ্য অধীরের কংগ্রেসও। |
বহরমপুরে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: গৌতম প্রামাণিক |
মাইক-বিভ্রাট নিয়ে ‘অন্তর্ঘাতে’র অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল শিবির। অধীর বলেছেন, তদন্ত হোক। এই ঘটনাপ্রবাহে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের তির্যক মন্তব্য, “অন্তর্ঘাত ওঁদের মুখস্থ! মাইকও রাজনীতি করতে শুরু করেছে নাকি!”
মাইকের তার ছেঁড়ার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর সভার সুর অবশ্য খানিকটা কেটেই ছিল। সাংসদ অধীর এবং মমতার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগী, বহরমপুরের বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীকে অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি। তবে আমন্ত্রিত ছিলেন মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনা, বিধানসভায় কংগ্রেসের পরিষদীয় নেতা মহম্মদ সোহরাব এবং মুর্শিদাবাদের সাংসদ মান্নান হোসেন। কিন্তু দলের ‘সিদ্ধান্ত’ মেনেই তাঁরা কেউ উপস্থিত হননি।
মান্নান স্পষ্টই বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে আমাকে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান হচ্ছে বহরমপুরে অথচ স্থানীয় সাংসদ হিসেবে অধীর চৌধুরী আমন্ত্রিত নন। এটা মেনে নিতে পারিনি। তাই যাইনি।” পরিষদীয় দলের নেতা সোহরাব বলেন, “সরকারি অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট জেলার সব দলের সাংসদ ও বিধায়কদের আমন্ত্রণ জানানোটাই গণতান্ত্রিক রীতি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সভায় সেই রীতিনীতির তোয়াক্কাই করা হয়নি। ফলে, ওখানে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না।” আর মৎস্যমন্ত্রী হেনার বক্তব্য, “দলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল সভায় না-যাওয়ার। সেই সিদ্ধান্ত মেনেই যাইনি।”
বহরমপুরের আগে, সকালে পড়শি জেলা কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আমন্ত্রণ পেয়েও যোগ দেননি শান্তিপুরের কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে। অজয়বাবু অবশ্য জানান, বিধানসভায় স্থায়ী কমিটির বৈঠক থাকায় যেতে পারেননি তিনি। পাশাপাশি দুই জেলার কোনও সভাতেই অধীর কিংবা শঙ্কর সিংহের এক বারও নামোচ্চারণ করেননি মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, দুই জেলা কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গেই জোট-রাজনীতিতে তৃণমূল নেত্রীর ‘সম্পর্ক’ সুবিদিত! |
জনসভায়। —নিজস্ব চিত্র। |
বহরমপুরে পৌঁছনোর পরে। —নিজস্ব চিত্র। |
|
মুখ্যমন্ত্রীর আচরণে অধীরের প্রতিক্রিয়া, “উনি তো সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। আমাকে কী করে আমন্ত্রণ জানাবেন! তবে এটুকু বলতে পারি, মুখ্যমন্ত্রী দলতন্ত্র ছাড়া কিছু বোঝেন না। গণতন্ত্রের একটা রীতিনীতি আছে। সরকারি অনুষ্ঠানের নামে উনি দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছেন।” জেলা কংগ্রেস সভাপতির আরও সংযোজন, “এই জেলায় বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছেন। আমাকে না-বলে মান্নান হোসেনকে নেমন্তন্ন করলেন! আবু হেনা, মহম্মদ সোহরাবকে বললেন। ভাবলেন কত পণ্ডিত নিজে! কত বড় ম্যাকিয়াভেলি! মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করে। এক জনই পুরুষ, বাকিরা মহিলা, এমন সরকারে কংগ্রেস বিশ্বাস করে না! আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করি।” পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল নেত্রীকে জবাব দেওয়ার ‘চ্যালেঞ্জ’ও এ দিন নিয়েছেন অধীর। এমনকী, বহরমপুরে মমতার সভায় ভিড় দেখে অধীর এমন কটাক্ষও করেছেন যে, সিপিএম লোক দিয়েছিল!
মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূল সভাপতি মহম্মদ আলি অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “সরকারি অনুষ্ঠানে কাকে ডাকা হবে, না হবে তা ঠিক করে সরকার, দল নয়।” জোট সরকারের মৎস্য প্রতিমন্ত্রী তথা মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘির তৃণমূল বিধায়ক সুব্রত সাহার মন্তব্য, “জোট সরকারে থেকে সরকারি সভায় না-যাওয়া কংগ্রেসের দ্বিচারিতার পরিচয়।”
দুই জোট-শরিকের এই চাপান-উতোরের মাঝে মুখ্যমন্ত্রীর মহাকরণকে নিয়ে জেলা-সফরে যাওয়ার ঘটনাকেই এ দিন কটাক্ষ করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু। তাঁর কথায়, “এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, মহাকরণ জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে! মন্ত্রীরা ঘুরছেন। সচিবেরা ভলভো বাসে চেপে ঘুরছেন! যে সময়ে দৈনন্দিন পর্যালোচনার দরকার, সেই সময়ে মহাকরণে কেউ নেই!” এতে সমস্যা কী হচ্ছে, তা বোঝাতে সূর্যবাবুর ব্যাখ্যা, “সচিবদের যেমন জেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তেমনই কর্মী, প্রকল্পের উপভোক্তাদের কাজের জায়গা থেকে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে। কাজ ব্যাহত হচ্ছে। স্কুলের মূল্যায়ন পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।” বহরমপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বিপুল খরচের অভিযোগ কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিরাও তুলেছেন জানিয়ে সূর্যবাবু বলেন, “রাজ্যের তহবিলে টানাটানি চলছে অথচ এত টাকা খরচ হচ্ছে কী ভাবে?” |
কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য |
বেলা বাড়লে কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে। —নিজস্ব চিত্র। |
|
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসুও মহাকরণে প্রশাসনকে আটকে না-রাখার কথা বলতেন। তা হলে এখন তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী মমতার জেলা-সফর নিয়ে সমালোচনা করছেন কেন? বিরোধী দলনেতার জবাব, “দু’টো এক নয়। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের কাজের কথা সে সময় বলা হয়েছিল। এখন তো সব কেন্দ্রীভূত হচ্ছে!”
প্রসঙ্গত, এ দিন দুই জেলার সভায় একাধিক প্রকল্পের শিলান্যাস, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড থেকে অনগ্রসর ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, ইন্দিরা আবাস যোজনার চেক বিতরণ থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের যন্ত্রাদি প্রদানের পাশাপাশি নদিয়ায় একাধিক হাসপাতাল ও কলেজ এবং মুর্শিদাবাদে অন্তত তিনটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এবং একটি ফুড পার্ক গড়ার আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুই জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর এবং শঙ্করের অবশ্য কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী যা প্রকল্পের কথা ঘোষণা করলেন, তার সিংহ ভাগই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প।” |
|
|
|
|
|