মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার কোপে ইউরোপ-আমেরিকায় ভারতীয় চিংড়ির চাহিদা কিছুটা মার খাওয়ায় ক’দিন যাবৎ রফতানির বাগদা একটু সস্তাতেই বিকোচ্ছিল স্থানীয় বাজারে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যহানির কারণ দেখিয়ে জাপান মুখ ফেরানোয় রাজ্যের চিংড়ি-চাষি ও রফতানিকারীরা কার্যত অগাধ জলে। জাপানই যে ছিল তাঁদের সবচেয়ে বড় খরিদ্দার!
ফলে সাগরপাড়ির জন্য চাষ করা বাঘা বাঘা চিংড়ি শহর-মফস্সলের বাজারে প্রায় জলের দরেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। কারবারিরা একে বলছেন, ‘অভাবী বিক্রি।’ ওঁদের সর্বনাশ হলেও ক্রেতাদের অবশ্য পৌষ মাস। খোলাবাজারে চিংড়ির দাম যত নামছে, আম-বাঙালির মুখের হাসি আরও চওড়া হচ্ছে। কেজিপিছু দেড়শো-দু’শো টাকাতেই অতিকায় বাগদা হাতের মুঠোয়!
পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফি বছর জাপান-ইউরোপ ও মার্কিন মুলুকে প্রায় হাজার কোটি টাকার চিংড়ি রফতানি হয়। এর ৬৫ শতাংশই যায় জাপানে। অথচ সেই জাপানই এ বার স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে এখানকার চিংড়ির বরাত বাতিল করে দিয়েছে বলে রাজ্য মৎস্য দফতর এবং সামুদ্রিক খাদ্য রফতানিকারীদের সংগঠন (সি ফুড এক্সপোর্র্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া) সূত্রের খবর। জাপানে পৌঁছে যাওয়া চিংড়িবোঝাই ২১টি কন্টেনার ফেরত এসেছে। প্রতিটায় ছিল প্রায় ৬০ লক্ষ টাকার মাছ।
এবং তার পরে পশ্চিমবঙ্গের চিংড়ি আমদানি পুরোপুরি বন্ধই করে দিয়েছে জাপান। কোন যুক্তিতে?
অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি রাজর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দুই ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরের চিংড়ি-চাষিদের থেকে প্রমাণ সাইজের যে সব বাগদা কিনে জাপানে পাঠানো হয়েছিল, সে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থা পরীক্ষা করে জানিয়েছে, ওগুলো মানবশরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ, তাতে ইথক্সিকুইন আছে। ওটি স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে বলে ওরা মনে করছে।” ইথক্সিকুইন কী?
চিংড়ি-কারবারিরা জানিয়েছেন, ভেড়িতে চিংড়ির পোনাকে দেওয়া খাবারে পচন-বিষক্রিয়া রুখতে মেশানো হয় এক ধরনের অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট। তারই নাম ইথক্সিকুইন। আর তাতেই আপত্তি জাপানি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এত দিন তো চিংড়ির খাবারে একই অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট মেশানো হতো! এ বার কী হল? রাজর্ষিবাবু জানান, গত মে মাসে ভিয়েতনাম থেকে পাঠানো মাছ পরীক্ষা করে জাপানের খাদ্য-পর্যবেক্ষকেরা তাতে সহন-অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট পেয়েছিলেন। ফলে ভিয়েতনামি চিংড়ির বরাত বাতিল হয়ে যায়। তারই জের ধরে পশ্চিমবঙ্গের বাগদার উপরে পরীক্ষা চলে। এবং এ রাজ্যের চিংড়িও জাপানি পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। ওড়িশার চিংড়িরও একই হাল। কিন্তু আমেরিকা তো পরিমাণে কম হলেও তা কিনছে? জাপান ব্যতিক্রম কেন? বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা: সাধারণ ভাবে ইথক্সিকুইন চিংড়ির স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ হলেও মানবশরীরে তার প্রভাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে নানা দেশের নানা মত। জাপানিরা খাবারে অ্যান্টি অক্সিড্যান্টের যে সহনসীমা বেঁধে দিয়েছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় তা অনেক কম। যেমন আমেরিকায় তা যেখানে লিটারপিছু ১ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), জাপানে সেটাই ০.০১ পিপিএম। “জাপানে আগে এই পরীক্ষা হয়নি। তাই সমস্যা হয়নি। এ বার হওয়াতেই সমস্যা।” বলছেন রাজর্ষিবাবু।
সেই সমস্যাই এখন গুরুতর চেহারা নিয়েছে। জাপানে পাঠানোর জন্য বাগদাবোঝাই আরও শ’খানেক কন্টেনার প্রস্তুত, অথচ সেখানে খদ্দের নেই। সরকারের হিসেবে, মিন (পোনা) থেকে রফতানিযোগ্য চিংড়ি বানাতে কেজিপিছু গড় ব্যয় প্রায় ২০০ টাকা। রফতানি না-হওয়ায় লাভ তো দূর, উৎপাদনের খরচই ওঠাতে পারছেন না চাষিরা। এতে রাজ্যের প্রায় চার লক্ষ চিংড়িচাষি এবং ২৫টি রফতানিকারী সংস্থা সঙ্কটে পড়েছে বলে ব্যবসায়ী-সূত্রের খবর।
রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনাও উদ্বিগ্ন। মন্ত্রী জানান, জাপান সরকারের সঙ্গে কথা বলার জন্য গত সপ্তাহে তিনি চিঠি লিখেছেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রীকে। মৎস্যমন্ত্রীর কথায়, “এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন আমাদের চিঠি দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে আমি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছি।” বিষয়টি তিনি মুখ্যমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন বলে মৎস্যমন্ত্রীর দাবি। জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশার চিংড়ি আমদানিতে ‘নিষেধাজ্ঞা’ রদের জন্য দরবার করতে জাপানে দল পাঠাবে দিল্লি। যাতে রফতানিকারীদের তরফে প্রতিনিধি রাখার দাবি উঠেছে। ভিয়েতনামের প্রতিনিধিরা টোকিওর সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে নিতে পেরেছেন। মাস চারেক বন্ধ থাকার পরে ফের ভিয়েতনামি চিংড়ির জন্য দরজা খুলেছে জাপান। ভারতও সে সুযোগ পায় কিনা, এখন তারই অপেক্ষা। |