প্রায় দৌড়তে দৌড়তে হোটেলে ঢুকে পড়ল সবুজ ট্র্যাকসুট পরা কয়েকটা চেহারা। দ্রুত পা চালাল ক্যাপসুল লিফটের দিকে। এক ঝলকে দেখে নেওয়া গেল, মুখগুলোয় উৎকণ্ঠার কালো ছায়া।
কয়েক মিনিটে ঘরে পৌঁছেই ওঁরা খবরের চ্যানেল খুলে বসে পড়বেন। ঘণ্টাখানেক আগে চ্যানেলগুলো জানিয়েছে, দামাস্কাসের অদূরে দারায়া শহরে পাওয়া গিয়েছে শতাধিক মৃতদেহ। ঘরের দিকে এগোতে এগোতে মহম্মদ আলাতার বিড়বিড় করছিলেন, “আমার বাড়িটা তো ওই শহরেই। জানি না কী হয়েছে। দেখি, ফোন করি।”
সিরিয়ার জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচ আলাতারকে ভরসা জোগানোর মতো কোনও শব্দ খুঁজে পাওয়া গেল না। তাঁর টিমের অবস্থাও তথৈবচ!
‘রাষ্ট্রবিরোধী’ গেরিলা বাহিনী ঠেকাতে দামাস্কাসের আনাচে-কানাচে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক। আর ওঁরা ভারতে এসে বুটের লেস বাঁধছেন! দেশের জার্সি পরে নামছেন নেহরু কাপের ‘যুদ্ধে’!
মাঠে যাওয়ার আগে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে টিভি দেখছে গোটা দল। টিম-বাসে উঠেও কানে মোবাইল। লম্বা ফোন চলছে দেশে। তার পর ম্যাচ। কিন্তু দিনের শেষেও চিন্তা কি আর পিছু ছাড়ে? অষ্টপ্রহরের টিভি চ্যানেল তো আর বন্ধ নেই। |
দলের সহকারী কোচের ব্যাপারটাই ধরা যাক। যেমন রবিবার দুপুরে কোচ-ম্যানেজারেরা দল বেঁধে বেরিয়েছিলেন কেনাকাটা করতে। দারায়া-হত্যাকাণ্ডের খবরটা কেউ তাঁদের কানে পৌঁছে দেয়। তার পরই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাঁদের হোটেলে ফিরে আসা। গত ক’দিন ধরে নেহরু কাপের খবর করার সূত্রেই সামান্য আলাপ হয়েছিল সহকারী কোচের সঙ্গে। সুতরাং, তাঁকেই ধরা গেল কথা বলার জন্য। কিন্তু তাঁকে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেই খেপে গেলেন শেফ দ্য মিশন তওফিক স্পারাহা “আমাদের দেশে সব ঠিক আছে। ওই ওবামা লোকটা আমাদের দেশটা মুঠোয় নিতে চাইছে বলেই লোকজন দিয়ে হাঙ্গামা পাকাচ্ছে। আর পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম বড় বড় করে সব দেখাচ্ছে!”
ভদ্রলোক সিরিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সচিব। আর সেখানকার ফুটবল সংস্থার মাথায় যিনি আছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের কাছের লোক তথা মন্ত্রিসভার সদস্য। সচিবকে পাঠিয়েছেন, যাতে কেউ বেঁফাস কথা না বলে ফেলে। দলের তিন জন ইংরেজি জানেন শেফ দ্য মিশন তওফিক, কোচ মারওয়ান ইউসুফ এবং সহকারী কোচ আলাতার। কিন্তু দেশের পরিস্থিতির কথা জিজ্ঞাসা করলে কোচ-ফুটবলার সকলেই কেমন খোলসে ঢুকে যাচ্ছেন। এমনকী, দলের এক সদস্যের সঙ্গে একটু কথা বলতে যেতেই কোথা থেকে এসে দুই সতীর্থ তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলে গেলেন!
এখানকার সিরীয় দূতাবাসও দেশ নিয়ে ফুটবলারদের কথাবার্তা বলতে বারণ করে দিয়েছে। নেহরু কাপের চারটে বিদেশি দলই ইন্ডিয়া গেটের কাছে একই হোটেলে উঠেছে। কিন্তু সিরীয় ফুটবলাররা ক্যামেরুন, নেপাল কিংবা মলদ্বীপের ফুটবলারদের সঙ্গে কথাই বলছেন না। নিজেরাই তিন-চারজনের দল করে ঘুরছেন। হোটেলে খোঁজ করে জানা গেল, বিদেশি দলগুলোর মধ্যে ফোনের কার্ড সবথেকে বেশি কিনছেন সিরীয়রাই। লবিতে চোখ বোলালে দেখা যাচ্ছে, মূলত তিনটে জায়গায় সিরীয়দের ভিড়। ফোনের কার্ড কেনার কাউন্টার, বিদেশি মুদ্রা ভাঙানোর কাউন্টার এবং যে কোনও টিভি, যেখানে খবরের চ্যানেল চলছে।
অথচ তার পরেও একটা ‘স্বাভাবিকতা’র মুখোশ যেন এঁটে রেখেছেন সকলে। সেটা বোঝা যাচ্ছে, কারণ উৎকণ্ঠাটা বেরিয়ে পড়ছে যখন-তখন। শরীরী ভাষাতেও সেটা স্পষ্ট।
অথচ প্রশ্ন করলেই তোতাপাখিকে শেখানো বুলির মতো শোনা যাচ্ছে, “ভারত ডেকেছে, তাই এসেছি। আমাদের দেশে সামান্য গণ্ডগোল হচ্ছে। কোনও কোনও এলাকায়। সেটা বেশি করে দেখানো হচ্ছে। ফুটবলে সমস্যা নেই।”
এক এক সময়ে মনে হচ্ছে, সিরিয়া সরকারও যেনতেনপ্রকারেণ দেখাতে চায়, সব স্বাভাবিক আছে। দেশের জনতা আছে প্রেসিডেন্টের পাশে। ম্যাচের সময়ে গ্যালারিতে যে গুটিকয়েক সিরীয় সমর্থককে দেখা যাচ্ছে তাঁরা মূলত হাইকমিশনের কর্মী। এঁদের দু’এক জন আবার প্রেসিডেন্ট আসাদের ছবি নিয়েও খেলা দেখতে আসছেন। উল্লাসের সময়ে তুলে ধরছেন সেই ছবি। জাতীয় পতাকা তো রয়েইছে। যেন প্রেসিডেন্ট এই বার্তাই দিতে চান, দেশে গণ্ডগোল থাকলে ফুটবল দল বিদেশে খেলতে আসবে কেন? কোচ-ম্যানেজার-ফুটবলাররা সকলেই প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, বরং ওবামার উপরে প্রচণ্ড রাগ দেখাচ্ছেন। আর গেরিলা বাহিনীর কথা উঠলেই সিঁটিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু দেশে যে গণ্ডগোল, তার ছাপ পড়ছে মাঠেও। গত দেড় বছর কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলতে পারেনি সিরিয়া। ফলে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে তারা নেমে গিয়েছে অনেকখানি। দলের কোচ মারওয়ান অবশ্য বলছিলেন, “সিরিয়ায় ফুটবল সবাই ভালবাসে। আমাদের দেশে ছোট-বড় অন্তত চল্লিশ হাজার ছেলে ফুটবল খেলে। খেলে টাকা উপার্জন করা যায়। ফুটবলের সঙ্গে কারও কোনও বিরোধ নেই।” তিনি এ কথা বললেন বটে, কিন্তু বাস্তব হল, ঝামেলার জন্য সিরিয়ার স্টেডিয়ামগুলো এখন সব বন্ধ। কোনও রকমে দিন পনেরো অনুশীলন করে দেশটা নেহরু কাপে খেলতে এসেছে। শিবিরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, টুর্নামেন্ট শেষে প্রেসিডেন্টের নির্দেশে পুরো দল ফিরবে দামাস্কাসে। টিকিট কাটা হয়েছে দু’রকম। ফাইনালে না উঠলে ১ সেপ্টেম্বর অথবা ফাইনালে উঠলে ৩ সেপ্টেম্বর (ফাইনাল ২ তারিখ)। কিন্তু প্রশ্ন হল, তারা আদৌ ফাইনালে উঠবে কি? কারণ, এখনও পর্যন্ত নেহরু কাপ এক ছন্নছাড়া সিরিয়াকেই দেখছে। যারা মাঠে নামছে, কিন্তু খেলায় যেন মন নেই। প্রস্তুতি তো নেই-ই। একটাও জয় নেই। ভারত, মলদ্বীপের কাছে হার, ক্যামেরুনের সঙ্গে ড্র। তাই দেশের কথা যেমন বলছেন না, তেমনই দলের কেউ কথা বলছেন না ফুটবল নিয়েও। বলবেন কী, মাথায় তো বাড়ির চিন্তা।বাড়ি ফেরার চিন্তা। এখান থেকে দামাস্কাস।তার পর কে কী করবেন, কোথায় যাবেন, ঠিক করেননি। টিমটায় বেশির ভাগেরই বাড়ি দামাস্কাস, আলিপ্পো এবং হোমসে। এবং প্রত্যেকটা শহরই এখন অশান্ত, ছন্নছাড়া। সব কিছু সত্যিই কি ‘ঠিক আছে’? |