কয়েক বার শোনা গিয়েছিল উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স-এর তরাই সুইৎজারল্যান্ডের মতোই হয়ে উঠবে। দিঘা রূপান্তরিত হবে গোয়াতে। শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনকে তিলোত্তমা করা হবে। হবে মাল্টিফাংশানালিটি কমপ্লেক্স। পর্যটকদের ভ্রমণকে আরও সুন্দর করার জন্য এ রকমই এক রেলবাস নিয়ে আসা হল। শিলিগুড়ি জংশন থেকে বাগডোগরা স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিমি ব্রড গেজ লাইনের ভিতরেই পাতা হল মিটার গেজ লাইন। ব্রড গেজ ট্রেন চলার ফাঁকে চালানো হবে এই রেলবাসকে। তেমনই পরিকল্পনা ছিল। চলবে রেললাইনে, কিন্তু ভিতরে বসার ব্যবস্থা বাসের মতো। বাসের ভিতরটা অসম্ভব নয়নাভিরাম। পুরুষ্ট নীল রঙের গদি। জানালায় লাগানো দামি কাচ। ভিতরে বসলেই শরীরের ক্লান্তি দূর হবে। চাঁদমণির অধুনা লুপ্ত চা-বাগিচায় গড়ে ওঠা অম্বুজা রিয়্যালিটির প্রাসাদগুলো ছেড়ে মাটিগাড়ার এখনও সবুজ চা-বাগানের মধ্যে রুপালি বালাসন ডিঙিয়ে এগিয়ে যায় রেলবাস। অত্যাধুনিক রেলবাসই বটে। লাইনের উপর দিয়ে চললেও যার কোনও শব্দের গোঙানি নেই। সদ্য প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর এ এক অসামান্য উপহার ছিল পর্যটকদের জন্য। শুধু পর্যটকদের জন্যই বা কেন? সুপারির বস্তা কিংবা নেপালের বনস্পতি দিয়ে ডাঁই করা বাসযাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখেই কি প্রাক্তন রেলমন্ত্রী এই রেলবাস চালানোর পরিকল্পনা করেননি? অটোর ধোঁয়ায় বিষাক্ত শিলিগুড়ির বাতাসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যও তো প্রয়োজন ছিল এই রেলবাসের। |
কিন্তু শব্দদূষণ-হীন এই বাস চালাবার পর একটি পয়সাও উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেল আয় করতে পারেনি। বিগত এক বছরে এই রেলবাসে উঠেছেন হাতে-গোনা দু’চার জন যাত্রী। তা-ও প্রথম দিকে। এখন এক জন যাত্রীকেও এই বাসে উঠতে দেখা যায় না। অথচ প্রতি দিন ডিজেল পুড়ছে ৪ হাজার টাকার বেশি। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়-বাগডোগরা-শিলিগুড়ি রাস্তায় প্রতি দিন যাত্রী যাতায়াত করেন পনেরো হাজারেরও বেশি। অলিখিত বাস অটো টার্মিনাস আবার শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন সংলগ্ন রেলের জমিতেই। মাত্র সাত টাকা বাস ভাড়া (এটা সত্যিকারের বাস অবশ্য) দিলেই শিলিগুড়ি মূল কেন্দ্র থেকে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। রেলবাসে পা রাখলেই ভাড়া চোদ্দো টাকা। আর সুইৎজারল্যান্ডের রেলবাস ধরতে হলে যাত্রীদের রিকশা ভাড়াই দিতে হবে ২৫-৩০ টাকা। তার পর চোদ্দো টাকা। তার থেকে যাত্রীদের কনুইয়ের গুঁতো কিংবা হাল্কা লাথি খেয়েও ৭-১০ টাকার ভাড়ায় বাগডোগরা পৌঁছানো কি শ্রেয় নয়? নেপালের সুপারির বস্তার সঙ্গে লেপ্টে থেকেও তো বাসের জানালা দিয়ে রেলবাস দেখা যায়। রেলবাস বড়ই মহার্ঘ। শহরের দূষণ কমানোর জন্য আর অটো চালকদের বেয়াদপি বন্ধ করতে রেলবাসকে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকেই চালাতে হবে। লাভের মুখ তখন দেখা যাবে।
|
থিয়েটারের মৃত্যু যখন শিশু মৃত্যুর হারকে হারিয়ে দিয়েছে, তখন উত্তরেরই প্রান্তে বসে বছরভর নাট্যোৎসবের প্রস্তুতি নিয়েছেন ‘কজন’। নাটকের মৃত নগরীতেই গড়তে চেয়েছেন স্বপ্নসম্ভবের রাজপ্রাসাদ। মন্মথ রায়ের আশীষ যে শহরের গ্রিন রুমের আলো প্রবল ঝড়েও জ্বেলে রাখে, সিরিয়ালের কামব্যাক যুগেও কাউন্টারে উপচে-পড়া ভিড়, চারশো জোড়া ক্ল্যাপিং সম্ভব বালুরঘাটে! বালুরঘাট নাট্যকর্মী এবং সমবেত নাট্যকর্মীর যৌথ উদ্যোগেই এ আয়োজন। বছরভর নাট্যযাপনের উৎসব চলছে বালুরঘাটে। স্থানীয় এবং বহিরাগত দলের যুগ্ম সমন্বয়ই এ উৎসবের ক্যাচ লাইন। এসেছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, সংস্তবের দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, রংরূপের সীমা মুখোপাধ্যায়, চিত্রা সেনের মতো ডাকসাঁইটে মঞ্চের মানুষগুলো তাঁদের নাটকের ডালি নিয়ে। আর অন্ধকার হলঘরেও একে বেঁকে জ্বেলে দিয়েছেন সংলাপের রংমশাল। অভিভূত শহরবাসী। বহু দিন বাদে শহরের প্রেক্ষাগৃহে সব ক’টি চেয়ার মানুষ পেল। সৌজন্যে উদ্যোগ পুরুষ নাট্য পরিচালক প্রদোষ মিত্র। সরকারি চাকুরি থেকে অবসরের পর তাঁর এই অভিনব নির্বাচন। বাকি জীবন নাটকের সঙ্গেই বইয়ে দিতে চান এই মানুষটি। দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘সামাজিক উৎসব’, সীমাদেবী বললেন, ‘একটা জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে আর একটা জ্যান্ত মানুষের সরাসরি যোগাযোগ, যা সিরিয়াল, সিনেমায় অসম্ভব’ নাটকের এমন ডেফিনেশন আগে শোনেনি শহরবাসী। অণু পরিবারের সাম্প্রতিক জটিলতাকে চুরমার করতে পারে ‘থিয়েটার থেরাপি’। প্রচুর মানুষকে একত্রে রিলেট করতে পারে এই জীবন্ত দর্শন। তাই নাটককে বাঁচাতে এক দল মানুষের বেঁধে বেঁধে বাঁচা। আর প্রায় ২৬০ বছরের এই আদিম শিল্পকে আর্কাইভে না-পাঠানোর আর্তি নিয়েই পথচলা শহরের। কোনও স্পনসর নেই, নেই কোনও সরকারি হেল্প, তবু চলছে-চলবে এই বাৎসরিক নান্দনিক বেঁচে থাকার মহোৎসব। তথ্য সংস্কৃতির দফতর আছে, কর্মী আছেন, শুধু হাতটা নেই। থিয়েটারের বেঁচে থাকার প্রাণপণ লড়াই প্রস্তুতিতেও ব্রাত্য করে নিল, দূরে সরিয়ে দিল দফতর। ক্ষোভ নয়, রাখি, বিবেক মেলা, বিজ্ঞানমেলার বাগানবাড়িও কি ওদের প্রাপ্য নয়? একটু ভাবার সময় হয়েছে। সুধিজন সংবর্ধনা কিংবা পুরস্কার থেকে ছিটেফোঁটা বাঁচলে এ শহরে পাঠিয়ে দিন। বাঁচবে নাটক, বাঁচবে কুশীলব, বাঁচবে পৃথিবী। মন্মথ রায়ের নাম জানে না যাঁরা, তাঁদের উদ্দেশে অভিমানী দূরত্বের বিদ্রোহ, নাট্য বিদ্রোহ চলছে দেখে যান মঞ্চের হাতিয়ারগুলো।
|
ছবি ও লেখা: সন্দীপন নন্দী। বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর
|
উঃবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এগারোতম অধিবেশন প্রাক্তনীদের |
এ বিভাগে ছবি ও লেখা দিলে পুরো নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করবেন।
উত্তরের কড়চা
এবিপি প্রাঃ লিমিটেড,
১৩৬/৮৯ চার্চ রোড
শিলিগুড়ি ৭৩৪৪০ |
|