ডেঙ্গি জীবাণুর বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশা যে শুধু প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত নিজেদের খাপ খাইয়ে নিচ্ছে তা-ই নয়, ধোঁয়া-কীটনাশকের ছোঁয়াচ এড়িয়ে বেঁচে থাকার উপায়ও বার করে ফেলেছে। এমনকী, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে পাল্টে ফেলেছে ডিম পাড়ার জায়গাও। পতঙ্গ-বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, এডিস ইজিপ্টাইয়ের ডিম এখন বিনা জলেই অন্তত তিন বছর বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছে।
আর এই সব কারণেই ডেঙ্গি এ বার এমন ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে উঠেছে বলে পরজীবী ও পতঙ্গ বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন। গত ক’বছরের তুলনায় এ বারের ডেঙ্গি সংক্রমণের ‘ব্যাপ্তিগত’ একটা বড় ফারাকও তাঁদের নজর এড়ায়নি। সেটা হল, কোনও বাড়িতে এক জনের ডেঙ্গি হলে বহু ক্ষেত্রে গোটা পরিবার আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। চিকিৎসকদেরও অনেকে জানিয়েছেন, মহানগরে ডেঙ্গির এমন তীব্র ও দ্রুত সংক্রমণ আগে তাঁরা দেখেননি। বাড়ির ভিতরে অন্ধকার, ঠান্ডা, সোঁদা জায়গায়, বিশেষত পর্দার পিছনে, খাটের নীচে বা জামা-কাপড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা ইজিপ্টাইয়ের হদিস এমনিতেই পাওয়া কঠিন। তার উপরে প্রতিকূল পরিবেশে জীবনধারণের ক্ষমতা নিয়ে তারা আরও দাপুটে হয়ে উঠছে বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন।
কলকাতা পুরসভার মশা গবেষণাকেন্দ্রের গবেষকেরা দেখেছেন, পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অন্য প্রজাতির মশার তুলনায় এডিস ইজিপ্টাইয়ের বেশি। তাই মশাবাহিত অন্যান্য রোগের চেয়ে ডেঙ্গি সংক্রমণের হারও অনেক বেশি। পাশাপাশি স্ত্রী ইজিপ্টাই মশা সময় বুঝে নিজেদের আঁতুড়ঘর বদলে ফেলছে। পুরসভার মশা গবেষণাকেন্দ্রের পতঙ্গবিদ দেবাশিস বিশ্বাসের কথায়, “আমরা বইয়ে পড়েছিলাম, ডেঙ্গির মশা অন্ধকার জায়গায় পরিষ্কার জলে ডিম পাড়ে। খোলা জায়গায় জমা পরিষ্কার জলে নয়। কিন্তু কলকাতার এডিস ইজিপ্টাই সে স্বভাব পাল্টে ফেলেছে। তারা এখন সূর্যের আলোর নীচে জমে থাকা পরিষ্কার জলে দিব্যি বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছে!” |
পুর-সূত্রের দাবি: ক’বছর আগে মূলত মধ্য কলকাতায় বিভিন্ন পুরনো বাড়ির ভিতরকার চৌবাচ্চাগুলো ছিল ডেঙ্গির আঁতুড়। এ নিয়ে পুরসভা ব্যাপক প্রচার চালায়। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝানো হয় যে, ডেঙ্গির হাত এড়াতে হলে নিয়মিত ওই সব চৌবাচ্চার জল ফেলে দেওয়া দরকার। “এতে সংক্রমণ কমেছিল। ভেবেছিলাম, রেহাই মিলল। কিন্তু সেই স্বস্তি উবে গিয়েছে।” বলছেন দেবাশিসবাবু।
স্বস্তি ফুরিয়ে যাওয়ার কারণ, এডিস ইজিপ্টাই এখন অন্ধকার স্নানঘরের চৌবাচ্চার বদলে অন্যত্র ডিম পাড়তে অভ্যস্ত। বস্তুত এ ক্ষেত্রে তারা ম্যালেরিয়ার পরজীবীবাহক অ্যানোফিলিস মশার স্বভাব অর্জন করেছে বলে দেবাশিসবাবুর দাবি। যার সুবাদে এডিস ইজিপ্টাই বাড়ির বাইরে পড়ে থাকা কৌটো-বোতল-টায়ারের জমা জলে অবাধে ডিম পাড়ছে। কোথাও আধ সেন্টিমিটার জল জমে থাকলেও তা হয়ে উঠছে ডেঙ্গিবাহী মশার প্রজননক্ষেত্র। পাশাপাশি গবেষকেরা দেখেছেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বংশবিস্তারের বাড়তি ক্ষমতাও এখন এডিস ইজিপ্টাইয়ের করায়ত্ত। যে কারণে জলের অভাবেও তার ডিম তিন বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। ওই সময়কালের মধ্যে জল পেলে সেই ডিম ফুটে শুককীট বা লার্ভা বার হয়। উপরন্তু ‘পরিবর্তিত’ চরিত্রের এডিস ইজিপ্টাই অপূর্ণ অবস্থাতেও ডেঙ্গি ভাইরাস বহনের শক্তি রাখতে পারে বলে গবেষকদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে।
আর এই সব মিলিয়েই মহানগরে এডিস ইজিপ্টাইকে বাগে আনা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন ওই গবেষকেরা। কলকাতা পুরসভার মশা গবেষণাকেন্দ্রের এই পর্যবেক্ষণ মিলে যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসিপি)-এর গবেষণার সঙ্গে। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গির লাগামছাড়া প্রকোপের পিছনে এডিস ইজিপ্টাইয়ের চারিত্রিক পরিবর্তনকেই দায়ী করেছে সিডিসিপি। পরজীবী-বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ডেঙ্গি ভাইরাসের উপস্থিতির দরুণ এডিস মশার ‘রক্তপিপাসা’ বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিতও পেয়েছেন। একই সঙ্গে পরিবেশের পরিবর্তনের জেরে বছরভর মাঝেমধ্যে বৃষ্টিতে বিভিন্ন স্থানে জল জমে যাওয়ায় মশার আঁতুড়ঘরের ব্যাপ্তিও বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পতঙ্গবিদেরা।
অর্থাৎ এক দিকে এডিস মশার পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের অভ্যাস বদলানোর প্রবণতা, অন্য দিকে বংশবিস্তারের ঢালাও সুযোগ। ডেঙ্গি সংক্রমণ মারমুখী হয়ে ওঠার পিছনে এই দুই ‘কারণের’ উপস্থিতি চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞেরাও মেনে নিচ্ছেন। পতঙ্গ-বিশেষজ্ঞ তথা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয় হাটি বলেন, “গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এডিস ইজিপ্টাই প্রধানত মানুষের রক্ত খায়। তাই মানুষের আশপাশেই তারা থাকে। সকালে সাতটা থেকে আটটা আর বিকেলে পাঁচটা-ছ’টার মধ্যে সাধারণত এডিস মশা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়।”
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডেঙ্গিবাহী মশার ‘সক্রিয়তা’র সময়ও পাল্টেছে কি না, তা আপাতত গবেষণাসাপেক্ষ। |