শিক্ষাঙ্গনে সাম্প্রতিক ‘বিশৃঙ্খলা’ নিয়ে সরকারের দুই শরিকই যথেষ্ট ‘বিব্রত’।
মঙ্গলবার মেয়ো রোড থেকে মহাজাতি সদনে সরকারের দুই শরিকের ছাত্র সংগঠনের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তাঁর বিভিন্ন সহকর্মীদের বক্তব্যেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল। শরিক কংগ্রেস নেতৃত্ব ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির দায় তৃণমূলের উপর চাপালেও, মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু শরিক দলের কাউকেই দোষারোপ করেননি। বরং তাঁর প্রায় এক ঘন্টার বক্তৃতায় মমতা দলীয় ছাত্রদের ‘মাথা ঠান্ডা রেখে, কারও সঙ্গে ঝগড়া না করে, শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলা’র জন্য পরামর্শ দিয়েছেন।
মমতা-সরকারের আমলে রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ শিক্ষক নিগ্রহ, দুই শরিকের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে, এমনকী তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর ছাত্রদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-র সমাবেশে মেয়ো রোডে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাদের ছাত্রদের বলছি, কোনও গোলমালে কেউ জড়াবে না। সিপিএম এবং এসএফআই চায় গোলমাল করে আমাদের বদনাম করতে। কিন্তু ওদের ফাঁদে পা দেবেন না।” দলীয় ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি সোজাসুজি বলেন, “একজন-দু’জন উত্তেজিত হয়ে যায়। আমি তাদের বলব, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।” |
মেয়ো রোডের এ দিনের সমাবেশে ছাত্রছাত্রীদের বিপুল উপস্থিতিতে ‘উচ্ছ্বসিত’ মমতা ও দলীয় নেতৃত্ব। রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সকলেই দাবি করেন, এ দিনের মতো ‘বিশাল সমাবেশ’ তাঁরা অতীতে দেখেননি। আর ‘সফল’ সমাবেশের জন্য তাঁরা ‘ধন্যবাদ’ দেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডাকে। বিশাল সমাবেশে ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য করে ব্রাত্যও বলেন, “ছাত্রদের কারও কারও আচরণে যদি ভুল হয়, তার জন্য তাদের, এমনকী আমারও কিছু হবে না। কিন্তু সমস্ত দোষ গিয়ে পড়বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। ফলে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।” খোলাখুলি না বললেও রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘বিশৃঙ্খলা’ নিয়ে তাঁরা যে উদ্বিগ্ন তা বিধায়ক তাপস রায়, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, গৌতম দেব এবং বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী ও কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যেই ইঙ্গিত মিলেছে। তাপস বলেন, “ছাত্ররা শৃঙ্খলাবদ্ধ হলে সংগঠন মজবুত হবে।” মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্যে উন্নয়নের কাজের কথা প্রচারের পাশাপাশি ছাত্রদের ‘মন দিয়ে পড়াশুনো’ করার কথা বলেন অরূপ। মেয়র বলেন, “রাজ্যে পড়াশুনোর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।”
শিক্ষাক্ষেত্রে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির জন্য মমতা সিপিএম এবং এসএফআই-কে দায়ী করলেও, কংগ্রেস দায়ী করেছে তৃণমূলকেই। জোট করে ‘পরিবর্তন’ এলেও শরিকদের হাতেই ছাত্র পরিষদকে নিগৃহীত হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। মহাজাতি সদনের সভায় ছাত্র পরিষদের প্রাক্তনী ও রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “জোটে একসঙ্গে লড়ে লাল সন্ত্রাস মুছেছি। রাজ্যে আজ শুধুই তেরঙা পতাকা। একটাই স্লোগান বন্দেমাতরম। তা হলে কেন কলেজের গেটে জোট শরিকের হাতে আমাদের ছেলেরা অত্যাচারিত হবেন?” বাম আমলের ‘গুণ্ডা’রাই রং বদলে তৃণমূলের ছত্রচ্ছায়ায় কংগ্রেসকে আক্রমণ করছে অভিযোগ করে রায়গঞ্জের সাংসদ দীপা দাশমুন্সি বলেন, “যে পতাকা হাতে নিয়ে ছাত্র পরিষদ অন্যায়-দুর্নীতির মোকাবিলা করছে, সেই একই পতাকা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছাত্র পরিষদকে মারছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ! দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।” রায়গঞ্জ, মাজদিয়া-সহ বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহে তৃণমূলকে দুষে দীপাদেবী বলেন, “রাজ্যে শিক্ষার অগ্রগতিকে নষ্ট করতেই তৃণমূল এই সব ঘটনা ঘটাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করাই তৃণমূলের লক্ষ্য।”
শিক্ষাক্ষেত্রের এই ‘নৈরাজ্যে’ রাজ্যে শিক্ষার মানের অবনমন ঘটছে বলে মন্তব্য করেন বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী। এর জন্য বাম জমানার পাশাপাশি নতুন সরকারও দায়ী বলে দাবি করে তাঁর বক্তব্য, “পরিবর্তনের পরে ছাত্ররা শিক্ষায় নতুন একটা পথ দেখতে চেয়েছিল। দুর্নীতিমুক্ত, দলতন্ত্রমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চেয়েছিল। কিন্তু বাম সরকারের জমানার পরিবর্তনের পরেও নতুন সরকার শিক্ষার উন্নতিতে নজর দিল না।” শিক্ষাক্ষেত্রে ‘নৈরাজ্যে’র বিরুদ্ধে পথে নেমে আন্দোলন করার পরামর্শ দেন মানস-অধীর-দীপারা। মহাজাতি সদনে ছাত্র পরিষদের ‘আঁতুড়ঘর’ পুনরুদ্ধারের দাবি জানান তাঁরা। |
ছাত্র সমাবেশেও দুই শরিকের আকচা-আকচি মহাজাতি সদনে যেমন ছিল, তেমনই ছিল মেয়ো রোডেও। কংগ্রেসের সমালোচনায় সরব ছিলেন প্রাক্তন ছাত্র নেতা অধুনা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সুব্রতবাবু ও খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। অবশ্য এই দুই মন্ত্রী ছাড়া মেয়ো রোডে মমতা-সহ কোনও বক্তাই কংগ্রেসকে আক্রমণ করেননি। সুব্রতবাবু তো বলেই বসেন, “কংগ্রেস এতদিন সিপিএমের ‘বি-টিম’ ছিল। এখন সিপিএমের একটি সাব কমিটি হয়ে গিয়েছে।” পঞ্চায়েত ভোটে কংগ্রেসকে বাদ দিয়েই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে বলেন জ্যোতিপ্রিয়। এ দিনই এআইসিসি-র সদস্য সমীর (বুয়া) চক্রবর্তী তৃণমূলে যোগ দেন। মেয়ো রোডের মঞ্চে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলে ‘স্বাগত’ জানান তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও রেলমন্ত্রী মুকুল রায়।
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের ‘হৃত গৌরব’ ফেরাতে মমতা দলের ছাত্রদের ‘মন দিয়ে পড়াশোনা’ করার কথা বলেন। তিনি জানান, বাংলার ছাত্রদেরও শিক্ষায়, কৃষ্টিতে দেশে-বিদেশের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে চান তিনি। এই প্রসঙ্গে মমতা জানান, তিনি একটি ‘নলেজ ব্যাঙ্ক’ তৈরি করছেন। এ জন্য যোগ্য ছাত্রছাত্রীদের একটি তালিকা তৈরির দায়িত্ব তিনি এ দিন দিয়েছেন যুব তৃণমূল নেতা সৌরভ চক্রবর্তীকে। পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন অধীরবাবুও। |