প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমানে দিল্লি থেকে তেহরান আসার পথে এক রাশভারী ভারতীয় কূটনীতিক অর্থবহ হাসি হেসে বললেন: ‘সিইং ইজ নট অলওয়েজ বিলিভিং’। অর্থাৎ, চোখের সামনে যেটা দেখা যায়, সেটাই সব সময় বাস্তব নয়।
আপাত ভাবে সকলের ধারণা, আমেরিকা এবং ইজরায়েলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক দশক পরে আবার তেহরানের মাটি স্পর্শ করলেন। মার্কিন-বিরোধী শিবিরের অনেকেই এই ঘটনায় উচ্ছ্বসিত। বলছেন, এটাই ভারতের সাবালক জোট নিরপেক্ষতা।
সাউথ ব্লকের অলিন্দ থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য মিলছে! বিদেশ মন্ত্রক সূত্র বলছে, ইরান-মার্কিন দ্বন্দ্বে এ বার গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ভারত।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) জন্ম হয়েছিল ১৯৬১ সালে জওহরলাল নেহরু এবং মার্শাল টিটোর উদ্যোগে বেলগ্রেডে। সেই স্বপ্নবিলাস আজও চলেছে। ন্যাম যতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাক, ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন না যে, ন্যামের সম্মেলেন যোগ দেওয়ার কোনও অর্থ হয় না।
এ বার তেহরানে ন্যাম সম্মেলন করে ইরানের প্রেসিডেন্ট মেহমুদ আহমেদিনেজাদ দেখাতে চান, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান নিঃসঙ্গ হয়ে যায়নি। ১২০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এখানে হাজির। ইজরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব পর্যন্ত তেহরানে আসছেন। এ কি কম কথা?
|
কিন্তু এটা নিছকই বহিরঙ্গ, বাস্তব গূঢ় কূটনীতি নয়। নেপথ্য কাহিনিটা ভিন্ন। তেহরান বাজার থেকে ইমাম খোমেনি মসজিদ আসার পথে এক নয়নাভিরাম, শান্ত ইরানের ছবি দেখতে দেখতে আর এক কূটনীতিকের কাছ থেকে শুনছিলাম সেই কাহিনি। যার প্রেক্ষাপট গড়ে দিচ্ছে কয়েকটি ঘটনা।
যেমন, প্রধানমন্ত্রীর তেহরান আসার ঠিক মুখে রাষ্ট্রপুঞ্জে আমেরিকার স্থায়ী প্রতিনিধি সুসান রাইস হঠাৎ ব্যক্তিগত সফরে দিল্লি এলেন। দেখা করলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন এবং বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাইয়ের সঙ্গে। দ্বিতীয়ত, তেহরানে এসে মনমোহন ইরানের ধর্মগুরু আয়াতুল্লা সঈদ আলি খামেনেইয়ের সঙ্গে দেখা করবেন।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, এই দু’টি ঘটনাই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ওবামা কৌশলগত কারণেই ইরানের সঙ্গে কোনও বড় ধরনের সংঘর্ষে যেতে চাইছেন না। বস্তুত, ইজরায়েল তাড়াহুড়ো করছে বলে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তও। তাঁর প্রশাসন ইজরায়েলকে বোঝাচ্ছে, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। নভেম্বরের পরে ইরান সম্পর্কে রণকৌশল স্থির করবে ন্যাটো।
এই অন্তর্বর্তী পরিস্থিতিতে ভারত ইরানকে বোঝাতে চাইছে যে, পরমাণু বোমা বানানোর চেষ্টা না করাই ভাল। কারণ, সেটাই তো ভিয়েনার আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রস্তাব। সেটাই তো ভিয়েতনামের হাভানায় এবং মিশরের শর্ম-আল-শেখে ন্যাম সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত। বিদ্যুৎ বা উন্নয়নের জন্য পরমাণু শক্তিকে কাজে লাগানো যাবে, কিন্তু পরমাণু বোমা কিছুতেই বানানো চলবে না।
এখন আহমেদিনেজাদ ইরানের প্রেসিডেন্ট হলেও প্রশাসনের অনেকটা নিয়ন্ত্রণই আলি খামেনেইয়ের হাতে। খামেনেই হলেন প্রায় আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মতো। আরএসএস যে ভাবে বিজেপি-কে নিয়ন্ত্রণ করে, খামেনেই ঠিক সে ভাবে মোল্লাতন্ত্রের মাধ্যমে তেহরানের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, মোল্লাতন্ত্রের উপদেষ্টাবর্গ খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর সঙ্গে আহমেদিনেজাদের সম্পর্ক মোটেই ভাল নয়।
এহেন খামেনেইয়ের সঙ্গে তলে তলে নানা কূটনৈতিক সূত্রে আমেরিকার একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু গোটা ইরানে আমেরিকা-বিরোধী জনমত প্রবল। তাই খামেনেই কখনও প্রকাশ্যে আমেরিকাকে সমর্থন করেন না। পরমাণু বোমা তৈরির জাতীয়তাবাদী স্বপ্নে আঘাত হানেন না। কিন্তু তীব্র মূল্যবৃদ্ধি বা খাদ্য সঙ্কটের প্রশ্নে আহমেদিনেজাদ প্রশাসনের সমালোচনা করেন। এমনকী সম্প্রতি কয়েক জন মন্ত্রীকে তিনি বরখাস্ত পর্যন্ত করে দিয়েছেন। এই অবস্থায় মনমোহনের মাধ্যমে খামেনেইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার চাণক্যনীতিই ওবামা প্রশাসন নিয়েছে বলে কূটনৈতিক মহলের অভিমত।
আমেরিকার বেশ কিছু ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ ইদানীং অবশ্য একটি ভিন্ন মত দিতে শুরু করেছে। সেটি হল, ইরান যদি পরমাণু বোমা বানিয়েই ফেলে, সেটাই বরং ভাল। তাদের যুক্তি, বোমা বানিয়ে ইরান তো আর সেটা ব্যবহার করতে পারবে না। যেমন পারে না ভারত বা পাকিস্তান। তখন এই গোটা এলাকায় ‘নিউক্লিয়ার ডেটারেন্স’ তৈরি হয়ে যাবে।
ইজরায়েল এবং আমেরিকার কর্তারা অনেকেই অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁদের মতে, ইরানের রাজনীতিতে এখন টালমাটাল চলছে। এই অস্থির দেশের হাতে পরমাণু বোমা দেওয়ার অর্থ উন্মাদনাকে উস্কে দেওয়া। সেখানে তখন তালিবানি শক্তি মাথা তুলতে পারে।
তা ছাড়া ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করলে সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক এমনকী ইরাকেও নতুন করে পরমাণু বোমা তৈরির আকাঙ্ক্ষা মাথাচাড়া দিতে পারে।
তাই ইরানের সঙ্গে আপাতত আলাপচারিতা জারি রাখতে চাইছে আমেরিকা। কখনও নেদারল্যান্ডস, কখনও বা অন্য কোথাও আমেরিকা-ইরানের মধ্যে ‘ট্র্যাক টু মিটিং’ হচ্ছে। সেই সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে ভারত।
সুতরাং, ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে মার্কিন উষ্মাই শেষ কথা নয়। আফগানিস্তান, ভারত এবং ইরানের বিদেশসচিবের ত্রিপাক্ষিক বৈঠক আমেরিকাকে শুধু রুষ্ট করবে, এমনটাও ঠিক নয়। কারণ, চোখের দেখাটা শেষ পর্যন্ত বাস্তব না-ও হতে পারে। যে কথা আজ তেহরান আসার পথে বলছিলেন ওই ভারতীয় কূটনীতিক।
কূটনীতি সত্যিই বড় কূট। |