|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
নিজস্ব রূপভঙ্গিতে ‘নায়িকা’ সিরিজের সেই মানবী |
আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত বিমানবিহারী দাসের একক প্রদর্শনী দেখে এলেন
মৃণাল ঘোষ। |
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস-এর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্টারে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল প্রখ্যাত ভাস্কর, কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বিমানবিহারী দাসের ভাস্কর্য ও ছবির পূর্বাপর প্রদর্শনী। মোট ৮৩টি নানা মাধ্যমের ভাস্কর্য ও ৮৪টি ছবি ও ড্রয়িং নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে শিল্পীর বহুমুখী প্রকাশভঙ্গির রূপরেখা।
বিমানবিহারী তাঁর ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে সব সময়ই ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার অন্তর্মুখীনতাকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন। আমাদের ভাস্কর্যের আধুনিকতার নির্মাণে পাশ্চাত্য আধুনিকতার আঙ্গিকগত বিশ্লেষণ অনেক সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আধুনিকতাবাদের প্রথম পথিকৃৎ রামকিঙ্কর অবশ্য দেশীয় আদিমতার নিহিত শক্তিকে নানা ভাবে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর ভাস্কর্যের নির্মাণে। মীরা মুখোপাধ্যায়ও লৌকিক ও আদিবাসী জীবনধারা থেকে রসদ সংগ্রহ করেছেন। ১৯৪০-এর দশকের অন্যান্য ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত, চিন্তামণি কর বা শঙ্খ চৌধুরী পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে আত্তীকৃত করতে চেষ্টা করেছেন দেশীয় রূপচেতনার ভিত্তির উপর। ছবিতে যেমন নব্য-ভারতীয় ঘরানার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য আত্তীকরণের একটি প্রকৃষ্ট ধারা গড়ে উঠেছিল, ভাস্কর্যে সে রকম কিছু ছিল না। তাই ভাস্কর্যে আত্মপরিচয় সন্ধান পাশ্চাত্য আধুনিকতার সঙ্গে এক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্কে বাঁধা ছিল এবং এখনও রয়েছে ।
|
|
শিল্পী: বিমানবিহারী দাস |
এই প্রেক্ষাপটে বিমানবিহারী গোড়া থেকেই একটি নতুন পরিসর সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। তাঁর জন্ম (১৯৪৩) ও বড় হয়ে ওঠা মেদিনীপুর জেলার তমলুকে। সেখানকার প্রকৃতি, ঐতিহ্যগত জীবনধারা ও শিল্পকলার ভিতর দিয়ে দেশজ আধ্যাত্মিকতার একটা অনুভব তাঁর ভিতর সঞ্চারিত হয়েছিল কৈশোর থেকেই। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে শিক্ষানবিশির পর নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ‘নায়িকা’ সিরিজের ভাস্কর্যে পৌঁছে তিনি একান্ত নিজস্ব একটি রূপভঙ্গি তৈরি করেছেন। ব্রোঞ্জের এই রচনায় এক নারী উপস্থাপিত হয়। মানবী বসে থাকে একটি হাঁটু তুলে। বাঁ হাতটি সেই হাঁটুর উপর প্রসারিত। শরীর ও উত্তোলিত পায়ের মধ্যবর্তী অংশে একটি শূন্য পরিসর রচিত হয়, যা সমগ্র রচনায় বিশেষ সুর সঞ্চার করে। ডান হাতটি উঠে গেছে মাথার উপর। স্পর্শ করে আছে অর্ধগোলকাকৃতির একটি বিশ্বের প্রতীকরূপ।
এই রূপকেই তিনি ক্রমান্বয়ে বিমূর্তের দিকে নিয়ে গেছেন। কালো মার্বল-এর একটি ‘নায়িকা’-র রূপারোপে দেখি শরীরের সমস্ত বিশদ রূপান্তরিত হয়ে একটি ডিম্বাকৃতি রূপে বিন্যস্ত হয়েছে। মধ্যবর্তী অংশে একটি বৃত্তাকার শূন্য পরিসর। ঊর্ধ্বাংশেও রয়েছে আয়তাকার শূন্যতা। এই দুই শূন্যের সংলাপের ভিতর দিয়ে মানবী চেতনার বিমূর্ত বোধ সংহত হয়ে থাকে। এই বিমূর্তায়ণে পাশ্চাত্যের উত্তরাধিকার অবশ্য আছে। কিন্তু তার ভিতর যে ভাবে অভিব্যক্ত হয় ঐতিহ্যগত আধ্যাত্মিকতা, তাতেই পরিস্ফুট হয় শিল্পীর নিজস্ব রূপচেতনা। তিনি দেশীয় লৌকিকের ভিতর থেকেও রূপ আহরণ করেন। জয়সলমিরের স্বর্ণাভ পাথরে যখন মসৃণতা ও অমসৃণতার সহাবস্থানে গড়ে তোলেন মানবীর মুখ, সেখানে নিয়ে আসেন যে প্রশান্ত তন্ময়তা তাতে অনুভব করা যায় লৌকিকের স্নিগ্ধ মাধুর্য। আবার ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তিতে তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী ভাস্কর্যের অধ্যাত্ম অনুভবকে বিশদ-বর্জিত সারল্যময় রূপারোপের দিকে নিয়ে যান। এই যে কয়েকটি ভাস্কর্যের কথা বলা হল, এগুলি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের অন্যতম। এখানেই তিনি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার প্রজ্ঞাদীপ্ত সমন্বয় সাধন করতে পেরেছেন। স্বাভাবিকতা-আশ্রিত অবয়বী রূপায়ণেও তাঁর দক্ষতা অনস্বীকার্য। আচার্য জগদীশচন্দ্র বোসের একটি আবক্ষ মুখাবয়ব মূর্তি সংস্থাপিত হয়েছে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ মুখাবয়ব ভাস্কর্যের দৃষ্টান্ত।
সফলতার যে নিরিখ তিনি তৈরি করেছেন, এই প্রেক্ষাপটে দেখলে তাঁর কয়েকটি কাজকে একটু সমস্যাসঙ্কুল মনে হয়। ‘বাডিং জয়’ দ্বাদশ সংখ্যক রচনাটি এর একটি দৃষ্টান্ত। এই বিমূর্ত রচনাটিতে একটি বেলনাকার বা সিলিন্ড্রিকাল স্তম্ভ উপর দিকে উঠে গেছে। তার শীর্ষদেশে স্থাপিত হয়েছে উপবৃত্ত আকৃতির একটি ফুলের আভাস, যার মধ্যবর্তী অংশে তিনি গড়ে তুলেছেন আয়তাকার শূন্য পরিসর। এই রচনাটিতে নিম্নাংশের স্তম্ভের রূপারোপকে খুবই যান্ত্রিক মনে হয়। উপরের অংশের সুরবিন্যাসের সঙ্গে এর ছন্দ কেটে যায়। নির্মাণের এই যান্ত্রিকতা তাঁর কোনও কোনও ভাস্কর্যকে সংকুচিত করলেও, সফল ক্ষেত্রগুলিতে তাঁর ছন্দবোধ খুবই প্রজ্ঞাদীপ্ত। ১৯৭০ দশক পরবর্তী ভাস্কর্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। |
|
|
|
|
|