জলপাইগুড়ি ভেঙে আলিপুরদুয়ারে নতুন জেলা গঠনের প্রস্তুতি তুঙ্গে। এই সময়ে ফের হলদিবাড়িকে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। প্রায় ১০ বছর ধরে নানা সময়ে হলদিবাড়ি পুরসভা, ব্যবসায়ীদের তরফে রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। এখন আলিপুরদুয়ার জেলা গঠনের তৎপরতা দেখে নাগরিক মঞ্চ গড়ে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হলদিবাড়ির বাসিন্দারা। কেন এমন দাবি উঠছে? জবাবে নাগরিক মঞ্চের উদ্যোক্তারা জানান, হলদিবাড়ি ও লাগোয়া ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের জনসংখ্যা ১৭ হাজার (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। বর্তমানে কোচবিহারের জেলার আওতায় থাকা হলদিবাড়ি ব্লকের দুদিকে জলপাইগুড়ি জেলা। একদিকে তিস্তা নদী এবং অন্যদিকে বাংলাদেশ। হলদিবাড়ি থেকে কোচবিহার জেলা সদরের দূরত্ব ১৩৫ কিলোমিটার। নিকটবর্তী মহকুমা শহর মেখলিগঞ্জ ৭৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জেলা শহরে যাওয়ার জন্য সরাসরি কোন সরকারি বাস চলে না। দুটি বেসরকারি বাস কোচবিহার ও হলদিবাড়ির মধ্যে যাতায়াত করে। মহকুমা শহর মেখলিগঞ্জ হলদিবাড়ির মধ্যে কোনও সরকারি কিংবা বেসরকারি বাস চলে না। আয়কর এবং বিক্রয় কর বাদে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সমস্ত দফতর কোচবিহার এবং মেখলিগঞ্জে অবস্থিত। যে কোনও সরকারি কাজে মহকুমা কিংবা জেলা সদরে যাতায়াত করতে একটা দিন লেগে যায়। তা ছাড়া সরাসরি কোচবিহার যেতে গেলে জলপাইগুড়িতে গিয়ে বাস অথবা ট্রেন ধরে যেতে হয়। মহকুমা শহর মেখলিগঞ্জে যেতে গেলে জলপাইগুড়ি এবং ময়নাগুড়িতে দুবার বাস বদল করে যেতে হয়। সাধারণ বাসিন্দাদের সময়, শ্রম এবং অর্থের অপচয় হয় বলে অভিযোগ। বাসিন্দাদের অনেকেই বলেন, “হলদিবাড়ি যেন কোচবিহার জেলার একটি ছিটমহল। যার সঙ্গে মূল জেলা কোনভাবেই যুক্ত নয়। কোচবিহার দূরে হওয়ার কারণে হলদিবাড়িতে সার এবং অত্যাবশ্যক সামগ্রীর মাঝে মাঝে অভাব দেখা দেয়। সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক সমস্ত কর্মসূচির ক্ষেত্রেও হলদিবাড়ি ব্রাত্য। যা কিছু হয় তা তিস্তার ওপারে কোচবিহারেই হয়।” পক্ষান্তরে, জলপাইগুড়ির সঙ্গে সংযুক্তি হলে কী ধরনের সুবিধা মিলবে সেই ব্যাখ্যাও দেন বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, নিকটবর্তী শহর জলপাইগুড়ির দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। জলপাইগুড়ির সঙ্গে সড়ক এবং রেল যোগাযোগ আছে। সহজেই যাতায়াত করা যায়। যে কোনও কাজে হলদিবাড়ির বাসিন্দারা জলপাইগুড়ির ওপর নির্ভরশীল। জলপাইগুড়ি জেলার সঙ্গে হলদিবাড়ি ব্লককে যুক্ত করা হলে যে কোন কাজে যাতায়াতের কোন সমস্যা হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজও অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। বাসিন্দাদের যুক্তি অনুযায়ী, বর্তমানে দরকার হলে মাথাভাঙার মহকুমাশাসকের হস্তক্ষেপ দরকার হয়। কারন হলদিবাড়ি থানাটি মাথাভাঙার এসডিপিও-এর অধীন। জলপাইগুড়ির নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। বর্তমানে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে হলদিবাড়ির মত সীমান্ত শহরের ক্ষেত্রে এই ব্যাবস্থা অবশ্যই দরকার বলে নাগরিক মঞ্চ মনে করে। |
জলপাইগুড়িতে অন্তর্ভুক্তির দাবি |
শুনেছি তিস্তা-তোর্সায় নৌকোয় পার হয়ে কোচবিহারে যাতায়াত করতে হত। এখন দুটো নদীতে সেতু হলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এবার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হতে চলেছে। সেখানে কোচবিহার জেলার সবকটি কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হলদিবাড়ি কলেজও আছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে যাতায়াত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমরা চাই জলপাইগুড়িতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হোক। হলদিবাড়ি কলেজকে তার আওতায় আনা হোক। জলপাইগুড়ির সঙ্গে হলদিবাড়ির সংযুক্ত হওয়া অবশ্যই দরকার।
বহ্নিশিখা রায়, প্রধানশিক্ষিকা, হলদিবাড়ি কলেজ |
|
১০ বছর আগে সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি। জেলা শহর কোচবিহার দূরে হওয়ায় ব্যাবসায়ীরা সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়ছি। লাইসেন্স নবিকরণ থেকে পারমিট সংগ্রহ, যে কোনও কাজে আমাদের ব্যবসা ছেড়ে কোচবিহারে যাতায়াত করতে অনেক সময় চলে যাচ্ছে।
স্বপন ঘোষ, সম্পাদক,
হলদিবাড়ি ব্যাবসায়ী সমিতি |
|
মামলার প্রয়োজনে হলদিবাড়ির বাসিন্দাদের ৭৪ কিলোমিটার পথ পার হয়ে মেখলিগঞ্জে যেতে হয়। সরাসরি বাস নেই। এমতাবস্থায় আদালতে সময়মত হাজিরা দেওয়া যে কী কষ্টকর ব্যাপার তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। এর ওপর আছে কোচবিহার আদালতে যাতায়াত। হলদিবাড়ি যেন কোচবিহার জেলার ছিটমহল হয়ে দাঁড়িয়েছে!
সৌরভ রায়, আইনজীবী,
মেখলিগঞ্জ আদালত |
|
তিস্তা নদী হলদিবাড়িকে কোচবিহার জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তিস্তার ওপারের কোচবিহার জেলার বাসিন্দারা আমাদের কষ্ট বুঝতে পারবেন না। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যে যোগাযোগের ধকল আমাদের পোহাতে হচ্ছে। জলপাইগুড়ির অন্তর্ভুক্ত হলে জলপাইগুড়ি আমাদের কাছের জেলা শহর হবে। আমাদের ভোগান্তি কমবে।
বাসুদেব বিশ্বাস, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক |
|
সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে হলদিবাড়ি বঞ্চিত। কোচবিহার জেলায় সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যা কিছু হয়, তার সবটাই তিস্তার ওপারে হয়। হলদিবাড়িতে দূরত্বের কারণে হয় না। হলদিবাড়ি বরাবর ব্রাত্য। জলপাইগুড়ি আমাদের জেলাশহর হলে এতটা বঞ্চনা হবে না বলে মনে হয়। তাই হলদিবাড়িকে জলপাইগুড়ির অধীনে আনার দাবি তুলেছি।
সমরেন্দ্র নারায়ণ দে, নাট্য পরিচালক |
|
আমরা হলদিবাড়িকে জলপাইগুড়ি জেলার সঙ্গে যুক্ত দেখতে চাই। আমরা কোচবিহার জেলায় থেকে সমস্ত বিষয়ে বরাবরের জন্যে বঞ্চিত। আমাদের বঞ্চনার ইতিহাস মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ভারতের রাষ্ট্রপতিকে জানানোর পরিকল্পনা নিচ্ছি। আমাদের দাবি না মানা হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলব।
শঙ্কর গঙ্গোপাধ্যায়, সম্পাদক, হলদিবাড়ি নাগরিক কমিটি |
|
কোচবিহারের ভারতভুক্তির সময় কী চুক্তি হয়েছে জানি না। হলদিবাড়ির ভৌগোলিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে হলদিবাড়ি জলপাইগুড়ি জেলার আওতায় আনা দরকার। এই দাবির পক্ষে এক বছর আগে পুরসভার কাউন্সিলাররা সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের দাবি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছি।
গৌরাঙ্গ নাগ,চেয়ারম্যান,
হলদিবাড়ি পুরসভা |
|
শিক্ষা বিষয়ক যে কোন কর্মশালা করতে কোচবিহার যেতে হয়। কাছের জলপাইগুড়িতেই সব কিছু হতে পারে। স্কুল পরিদর্শকের অফিসে কাজ থাকলেও কোচবিহারে যেতে হয়। পঠনপাঠনে ক্ষতি হয়।
শর্মিষ্ঠা সিংহ, শিক্ষিকা, হলদিবাড়ি হাইস্কুল |
|
বাস্তবটা বুঝতে হবে। কোচবিহারের ঐতিহ্য অসম্মান না করে আমি বলছি, হলদিবাড়িকে জেলার সঙ্গে জুড়লে বাসিন্দাদের সুবিধা হবে।
সুধা প্রধান, সঙ্গীত শিল্পী |
|