|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
স্বাধীনতা-দীনতায়... |
সরকার তাহার ক্ষমতাবলে অনেক কিছুই, প্রায় সব কিছুই, নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে। কিন্তু তাহার অর্থ ইহা নহে যে সরকার তাহার ক্ষমতাবলে নিয়ন্ত্রণের কাজটি করিলেই তাহা যথার্থ পদক্ষেপ হইবে। বরং এই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কতখানি কম প্রয়োগ করিয়া প্রশাসন চালানো যায়, ইহাই যে কোনও সভ্য সরকারের মানদণ্ড হওয়া উচিত। বিশেষত ব্যক্তি-নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রটি নিয়ন্ত্রণের আগে তো এই ক্ষমতা প্রয়োগের ঔচিত্য লইয়া গভীরতম সংশয় থাকা উচিত। তেমন কোনও সংশয়ের লেশমাত্র চিহ্ন ছাড়াই চূড়ান্ত প্রত্যয়ের সহিত বর্তমান ইউ পি এ সরকার সম্প্রতি যাহা করিল, তাহা অপশাসনের বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত। উত্তর-পূর্ব ভারতের অসমবাসীদের ভয়ংকর সংকটের মুখে, দেশের সর্বত্র নানা গুজব ছড়ানোয় তাহাদের প্রাণভয়ে পলায়নের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ইন্টারনেটের অনেকগুলি সাইট নিষিদ্ধ করিয়া দিল, যাহাতে হানিকর গুজব আর বেশি ছড়াইবার সুযোগ না পায়। এই রূপ হানিকর গুজব যাহারা ছড়াইয়া থাকে তাহাদের তীব্র শাস্তি প্রাপ্য, সন্দেহ নাই, কিন্তু তাই বলিয়া প্রথমেই ইন্টারনেট সাইট ব্লক করিবার এই প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়াও যে অতীব অসঙ্গত এবং বিপজ্জনক, তাহাতেও সন্দেহের বিশেষ অবকাশ পাওয়া ভার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলিয়া ভারতের অনেক গৌরব। সুতরাং সেই গণতান্ত্রিকতার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ, বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যাহাতে এক চুলও ক্ষুণ্ণ না হয়, সে বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখাও ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্যসমূহের একটি। এই কর্তব্য হইতে একটিমাত্র চ্যুতিরও অর্থ: গণতন্ত্র হারাইয়া কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রতন্ত্রের পথে একটি পা ফেলা। ২০১২ সালের ভারত সরকার কি তবে সেই পথেই অগ্রসর হইতে চায়?
যে কোনও লিখিত বা কথিত মত প্রকাশের ক্ষেত্রেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা আপত্তিকর। কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রকাশিত মত যদি সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া নিয়ন্ত্রণ করিতে চায়, সে ক্ষেত্রে এই আপত্তির একটি প্রায়োগিক দিকও থাকে। ইন্টারনেট আংশিক ভাবে নিষিদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব একটি লক্ষ্য। হয় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা, নয়তো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ইহার মাঝামাঝি কোনও ইন্টারনেট নীতি প্রণয়নই সম্ভব নয়। কারণটি অত্যন্ত সহজ: সরকারি আমলারা জানুন না জানুন, বহু নাগরিকই কিন্তু ইত্যবসরে শিখিয়া গিয়াছেন কত সহজে ঘুরপথে নির্দোষ সাইটের মাধ্যমে নিষিদ্ধ সাইটে প্রবেশ করিতে পারা যায়, অন্য কেহ কানাকড়িও টের পায় না। সুতরাং, যে নিষেধাজ্ঞা নীতিগত ভাবেও আপত্তিকর, এবং প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ হইতেও অর্থহীন, তেমন পদক্ষেপণ করিয়া ভারতীয় সরকার কী অর্জন করিবার আশা করে?
প্রয়োজনে দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শাস্তিবিধান এবং পাশাপাশি সামাজিক সহনশীলতা বাড়ানোর জন্য বিবিধ নীতি গ্রহণ: ইহা ব্যতীত এই কঠিন সংকট পার হইবার বস্তুত কোনও উপায় নাই। আর সব পথই দুর্বলতার পথ, পরাজয়ের পথ। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের নানা বক্তব্যের ব্যঙ্গাত্মক বিকৃতি ঘটিতেছে বলিয়া টুইটার বন্ধ করিলে সেই ব্যঙ্গ-বক্তব্যের অপেক্ষা বড় ব্যঙ্গ হইয়া দাঁড়ায় টুইটার-বন্ধের সিদ্ধান্ত। বিশ্বের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবোধ কিংবা মর্যাদা কিংবা সহনশীলতা কি এতই কম যে নেহাত ‘ক্যারিকেচার’ দেখিয়া তিনি বা তাঁহার অফিস তাহা হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিবেন না? দারোগা-পুলিশ ডাকিয়া প্রহসনের একশেষ না করিয়া পারিবেন না? ব্যঙ্গকারীকে শাস্তি দিতে গিয়া গোটা সমাজের স্বাধীনতা হরণ না করিয়া পারিবেন না? কিছু কাল আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সহনশীলতার আশ্চর্য দৈন্যও এই একই প্রশ্ন উঠাইয়াছিল। বাংলা আজ যাহা ভাবে, ভারত ভাবে কাল! |
|
|
|
|
|