এত বয়সে মা হচ্ছে মেয়েটা!
বাড়ির সকলেই খুশি, একই সঙ্গে চিন্তিতও। খেতে-শুতে-উঠতে-বসতে সর্বক্ষণ কড়া নজরদারি। মেয়েটার যেন ক্ষতি না হয়। ছোট্ট অতিথি যেন সুস্থ শরীরে পৃথিবীর আলো দেখে। আইসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলছেন, মায়েদের দিক থেকে নজর সরিয়ে এক বার বাবাদের দিকেও ‘নজর’ দিন। বেশি বয়সে বাবা হওয়ার কথা ভাবছেন যাঁরা, তাঁদের প্রতি বিজ্ঞানীদের কড়া হুঁশিয়ারি আপনার থেকেই হয়তো সন্তানের শরীরের বাসা বাধতে পারে অটিজম কিংবা স্কিৎজোফ্রেনিয়া কিংবা ডিসলেক্সিয়ার মতো জেনেটিক ডিসঅর্ডার (জিনগত ত্রুটি)। ‘নেচার’ পত্রিকায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীদের দাবি, সন্তানের শরীরে ‘জেনেটিক মিউটেশন’ বা জিন-পরিবর্তনের ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রের জন্যই ছেলেদের ৪০ পেরিয়ে বাবা হওয়া দায়ী। এ সব ক্ষেত্রে বাবার শরীর থেকেই সন্তানের শরীরের চলে আসে বদলে যাওয়া জিন। আর মায়েরা? একেবারে ‘নিষ্পাপ’। এ বিষয়ে তাঁদের সে অর্থে কোনও ভূমিকাই নেই।
কী ভাবে এমন দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা?
গবেষণাপর্বে আইসল্যান্ডের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেমব্রিজের গবেষকেরা। সন্তান অটিজম বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, এমন ৭৮টি পরিবারকে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন গবেষণার কাজে। পরিবারের প্রত্যেকের জিনের গঠন খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেন বিজ্ঞানীরা। একই সঙ্গে, এমন ১০০টি পরিবারকেও গবেষণায় কাজে নিয়োগ করেন, যাঁদের বংশে এ সব রোগের ছায়াও নেই। দু’তরফের জিনের গঠন তুলনা করে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, বেশির ভাগ সময়ে অটিজম বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ার জন্য ‘বেশি বয়সে বাবা হওয়াই দায়ী’।
মনে পড়ে ‘তারে জমিন পর’-এর ঈশান অবস্তির কথা। ছোট্ট ছেলেটা কিছুতেই মনে রাখতে পারে না ঠিক কেমন দেখতে ‘বি’। বইয়ের দিকে তাকালেই চোখের সামনে খেলা করে বেড়ায় অক্ষরেরা। বুঝতে পারে না ছুটে আসা বলটা কী ভাবে ধরবে সে? রোগের নাম ডিসলেক্সিয়া। এমনই আর এক রোগ স্কিৎজোফ্রেনিয়া। আক্রান্ত ছেলে কিংবা মেয়েটি মনের কথাগুলো কিছুতেই সাজাতে পারে না মাথায়। অটিজম সমাজে থেকেও তাদের যেন অন্য জগতে বাস। আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদানে কোথাও একটা গণ্ডগোল। এই রোগে বাচ্চারা বারবার একই কাজ করতে থাকে। আবার এই এক কাজই করতে করতে কারও কারও জীবনে দেখা যায় প্রতিভার অভূতপূর্ব বিকাশ। কেই হয়ে ওঠেন বড় গায়ক, কেউ আবার আঁকিয়ে। যেমন রেনম্যান ছবিতে অটিজমে আক্রান্ত রেমন্ড। অঙ্কে তুখোড়। অঙ্কের যে কোনও জটিল ধাঁধা সমাধান করা, তার কাছে ‘বাঁ হাতের খেল’। কিন্তু টাকাপয়সার হিসেব বোধগম্য হয় না তার। বহু কাল যাবৎ মনে করা হত, এই সব রোগের পিছনে মেয়েদের বেশি বয়সে মা হওয়াই দায়ী।
মুখ্য গবেষক কারি স্টিফেনসন বলেন, “একটি শিশুকন্যার জন্মের আগেই মায়ের গর্ভে থাকার সময়ে তার শরীরে ডিম্বাণু তৈরির প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয়ে যায়। (এ সময় প্রায় ২০ লক্ষ প্রাথমিক কোষ উগোনিয়া জমা হয় ডিম্বাশয়ে। এর পর মেয়েটি বয়ঃসন্ধিক্ষণে পৌঁছলে উগোনিয়া থেকে প্রাইমারি উসাইট, তার থেকে ডিম্বাণু তৈরি হয়।) ফলে ডিম্বাণুতে মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটা সম্ভব নয়। কিন্তু ছেলেদের শরীরে বেশি বয়সেও শুক্রাণু উৎপাদন চলতেই থাকে।” বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জিন-চরিত্রে মিউটেশন ঘটতে থাকে। বছর কুড়ির একটি ছেলে বাবা হলে, সন্তানের শরীরে ২৫ শতাংশ জিন-পরিবর্তন ঘটতে পারে। কিন্তু ৪০ পেরিয়ে এক ভদ্রলোক যখন বাবা হচ্ছেন, তখন দেখা যাচ্ছে তাঁর সন্তানের শরীরে ৬৫ শতাংশ জিনেই পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটে গিয়েছে। আর এই পরিবর্তনের ফলেই অনেক ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হচ্ছে সন্তান।
স্টিফেনসনের কথায়, “একটা বিষয় পরিষ্কার। মেয়েদের বেশি বয়সে মা হওয়া নিয়ে আমরা এত সচেতন, এত চিন্তা করি। ছেলেদের বেশি বয়সের বিপদ যে অলক্ষেই উঁকি মারছে, তা এক বারের জন্যও ভেবে দেখি না। অথচ সন্তানের শরীরে জেনেটিক ডিসঅর্ডার-এর জন্য ছেলেদের ‘বুড়িয়ে’ যাওয়া মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি দায়ী।”
বিশেষজ্ঞেরা তাই বলছেন, ৩০-এর কোঠা ছাড়ালেই, ছেলেরা সাবধান! |