কোনও সরকারি অফিসার স্রেফ নিজের কাজটুকু ঠিকমতো করলেই যে মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জহরলাল ভৌমিক। মাঠে নেমে হাতে কলমে চাষের নতুন নতুন পদ্ধতি শিখিয়ে, সরকারি প্রকল্পগুলিকে নাগালের মধ্যে এনে দিয়ে চাষিদের ‘কাছের মানুষ’ হয়ে উঠেছেন তিনি। আর সে কারণেই রুখাসুখা জেলা পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর-১ এবং পাড়া ব্লকের কৃষি উন্নয়ন আধিকারিকের (এডিও) দায়িত্ব থেকে জহরলালবাবুর বদলির কথা জেনেই প্রমাদ গুনছেন ওই অঞ্চলের চাষিরা। তাঁদের আশঙ্কা, ভিন্ জেলা থেকে যাঁরা আসবেন, তাঁরা কি আদৌ মাঠেঘাটে নামা ‘শিক্ষক’ হয়ে উঠতে পারবেন?
এই আশঙ্কা থেকেই জহরলালবাবুর বদলির নির্দেশ রুখতে এক জোট হয়েছেন চাষিরা। জেলা ও রাজ্য কৃষি দফতরে গণস্বাক্ষরিত স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। পাড়ার ফতেপুর গ্রামের ইমরান আনসারি বা রঘুনাথপুরের সেনেড়া গ্রামের গণেশ মণ্ডল, নারায়ণ মণ্ডলের মতো চাষিদের বক্তব্য, “এর আগে ব্লকের কোনও কৃষিকর্তাকে হাতেকলমে চাষের পদ্ধতি বোঝাতে দেখিনি।”
অথচ ঘটনা হল, ওই দুই ব্লকের দায়িত্বটি জহরলালবাবু গত দু’বছর ধরে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে সামলাচ্ছেন। তিনি আদতে রঘুনাথপুর মহকুমার সহকারী কৃষি অধিকর্তা (সাবজেক্ট ম্যাটার)। কিন্তু, দু’বছরেই ব্লকের চাষিদের এতটা ‘কাছের জন’ হয়ে পড়েছেন তিনি, যে তাঁর বদলি রুখতে উঠেপড়ে লেগেছেন চাষিরা। |
কোন রসায়নে আজ তিনি চাষিদের ‘কাছের জন’? উত্তর লুকিয়ে রয়েছে জহরলালবাবুর কাজের পদ্ধতির মধ্যেই। যা চট করে অন্য কোনও আধিকারিকের মধ্যে দেখা যায় না বলেই অভিমত চাষিদের। বস্তুত, মাঠে গিয়ে নিয়মিত কাজ করেন, এমন অফিসার সত্যিই বিরল বলে মানছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার। তিনি বলেন, “ওই কৃষি আধিকারিক নিশ্চয় ভাল কাজ করেছেন। তাই চাষিরা তাঁকে নিজেদের কাছে রাখতে চাইছেন।”
আসলে দফতরে বসে দশটা-পাঁচটার অফিস করাটাই তাঁর ধাঁচে নেই। জহরলালবাবু বলছেন, “এই রুখা জেলায় চাষের উন্নতি করতে হলে দফতরে বসে থাকলে হবে না। দফতরে আর কত জন চাষিই বা আসেন! তাঁদের আসল সমস্যা বুঝতে গেলে মাঠে যেতে হবে।” পাড়া ব্লকের ফার্মার্স ক্লাবের চিফ কো-অর্ডিনেটর মঙ্গল কৈবর্ত বলেন, “এই জেলায় চাষের মূল সমস্যাই জলের অভাব। জহরলালবাবু গ্রামে এসে শিখিয়েছেন ‘শ্রী’ (সিস্টেম অফ রাইস ইনটেন্সিফিকেশন বা এসআরআই) পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে কম জলেও কী ভাবে বেশি ফলন সম্ভব। ওই ভাবে চাষ করে বিঘা প্রতি গড়ে ২০ মন ধানের বদলে এখন প্রায় ৩০ মন পাচ্ছি।” পাড়া ও রঘুনাথপুর ১ ব্লকে চাষিদের বুঝিয়ে প্রায় ৭৫০ হেক্টর জমিতে শ্রী পদ্ধতিতে চাষ শুরু করতে পেরেছেন তিনি।
পাড়া ব্লকের সুরুলিয়া গ্রামের চাষি সুভাষ মাহাতো, শম্ভু রাজোয়াড়, কালীপদ কৈবর্তদের কথায়, “বছর দু’য়েক আগে পর্যন্ত চাষ সংক্রান্ত সরকারি কোনও কর্মসূচি বা প্রকল্প জানতে পারতাম না। জহরবাবু এসে বুঝিয়েছেন, খরিফ মরসুমে উঁচু জমিতে যেখানে জলের অভাবে ধান হয় না, সেখানে বাদাম, ভুট্টা, কলাই চাষ করা যায়। সরকারি সাহায্যে বীজের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন।”
বিকল্প ফসল ফলানোয় চাষিদের রাজি করাতে অবশ্য বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছে জহরলালবাবুকে। তিনি বলেন, “পুরুলিয়ায় প্রচুর উঁচু জমি রয়েছে। সেখানে সরকারি সাহায্যে বাদাম, ভুট্টা, কলাই চাষ করলে লাভবান হবেন চাষিরা। এই বিষয়টিই গ্রামে গিয়ে হাতেকলমে দেখাতে হয়েছে।”
এখানেই শেষ নয়। প্রথাগত যে সার চাষিরা ব্যবহার করেন, তার বদলে ঠিক সময়ে ইউরিয়া, পটাশ ব্যবহারে ভাল ফল মেলার কথাও চাষিদের বুঝিয়েছেন জহরলালবাবু। প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সারের দোকানে পোস্টার দিয়ে নিজের মোবাইল নম্বরও লিখে রেখেছেন। এ ভাবে তিনি চাষিদের কাছে ‘কৃষি-শিক্ষক’ হয়ে উঠেছেন।
বৃষ্টির জল ধরে চাষের একটি প্রকল্পে পুরুলিয়ায় জহরবাবুর সঙ্গে কিছু কাজ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং রাজ্য কৃষি কমিশনের সদস্য তরুণকুমার বসু। তিনি বলেন, “জহর প্রমাণ করেছে, একজন বিশেষজ্ঞ চাষিদের আন্তরিক ভাবে সাহায্য করলে পুরুলিয়ার রুক্ষ জমিতেও সোনা ফলানো সম্ভব!”
তাঁর বদলি রোখার দাবি প্রসঙ্গে বর্ধমানের পূর্বস্থলীর বাসিন্দা, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র জহরবাবু বলছেন, “বরাবরই চেষ্টা করেছি চাষিদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে তাঁদের চাষের উন্নত পদ্ধতি বোঝাতে। চেষ্টা করেছি সরকারি প্রকল্পগুলি চাষিদের কাছে পৌঁছে দিতে। হয়তো কাজটা ঠিক ভাবে করতে পেরেছি বলেই তাঁরা ভালোবেসে ওই দাবি করেছেন।”
মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান কৃষি উপদেষ্টা কিন্তু জানিয়েছেন, সরকারি চাকরিতে বদলি থাকে। আরও বড় দায়িত্ব নিয়ে ওই কৃষি আধিকারিক যাতে কাজ করেন, সেটাও চাষিদের দেখতে হবে। বিষয়টি তিনি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেও জানিয়েছেন প্রদীপবাবু। পুরুলিয়ার জেলা কৃষি অধিকর্তা অশ্বিনী কুণ্ডুও বলেন, “জহরলালবাবু নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন বলেই চাষিরা আবেগে তাঁর বদলি রোখার দাবি করেছেন। কিন্তু সরকারি নির্দেশ মানা আমাদের কর্তব্য।” মহাকরণে কৃষি দফতরের এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, “জহরবাবুর পদোন্নতি হচ্ছে। তিনি মহকুমায় ৫টি ব্লকের দায়িত্বে থাকবেন। তাতে তিনি ওই দুই ব্লক ছাড়াও আরও অনেক চাষির কাছে পৌঁছতে পারবেন।”
অর্থাৎ, রুখা জেলায় আরও সোনা ফলার স্বপ্নটা এখনই মরছে না!
|
(সহ প্রতিবেদন: মিলন দত্ত ও দিবাকর রায়) |