জানলার গ্রিল ভেঙে বাড়িতে ঢুকে এক বৃদ্ধাকে খুন করে পালাল দুষ্কৃতীরা। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে চিৎপুর থানার অন্তর্গত পাইকপাড়ার গাঙ্গুলিবাগান লেনে। মৃতার নাম ফুলরেণু চৌধুরী (৬৮)। অবিবাহিত ওই মহিলা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। বছর আটেক আগে অবসর নেন। পুলিশ জানায়, ওই বৃদ্ধার বালা এবং কানের দুল নিয়ে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। তবে ঘরে লুঠপাটের তেমন চিহ্ন মেলেনি। এই ঘটনায় কোনও পরিচিতের হাত রয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তের পরে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
ফুলরেণুদেবী যে বাড়িতে থাকতেন, তার পাশের বাড়িতেই থাকেন তাঁর দুই ভাই (হিমাদ্রি ও বিনয় চৌধুরী)। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী হিমাদ্রিবাবু জানান, তাঁর দিদি আগে শোভাবাজারের বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ে থাকতেন। ২০০৩ সালে হিমাদ্রিবাবু তাঁর প্রতিবেশী পার্থসারথি সরকারের বাড়ির একতলাটি কিনে নেন। ২০০৪ সালে অবসরের পর থেকে ওই বাড়ির একতলায় একাই থাকতে শুরু করেন ফুলরেণুদেবী। দোতলায় থাকেন বাড়ির অন্যতম মালিক পার্থসারথিবাবু। খুনের পরে অবশ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে চাননি পার্থবাবু ও তাঁর পরিবার।
কী হয়েছিল মঙ্গলবার রাতে?
পুলিশ সূত্রের খবর, রাত তিনটে নাগাদ ধুপধাপ শব্দে আচমকাই পার্থবাবুদের ঘুম ভেঙে যায়। বাড়িতে যে কিছু একটা হচ্ছে, সে খবর তাঁরাই হিমাদ্রিবাবুদের দেন। হিমাদ্রিবাবু এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এসে দেখেন, ফুলরেণুদেবীর ঘরের সদর দরজা খোলা। খাবার টেবিলের সামনে মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন তিনি। পুলিশের অনুমান, ওই বৃদ্ধার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার পরে শ্বাসরোধ করে তাঁকে খুন করা হয়েছে।
এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে যান লালবাজারের হোমিসাইড এবং ডাকাতি-দমন শাখার অফিসারেরা। আসেন গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ-সহ কলকাতা পুলিশের পদস্থ কর্তারাও। পল্লববাবু জানান, পিছনের একটি জানলার গ্রিল ভেঙে দুষ্কৃতীরা ঢুকেছিল। খুন করার পরে সামনের দরজা খুলে চম্পট দেয় তারা। ঘটনাস্থল থেকে একটি কাঠের হাতল এবং এক জোড়া চটি বাজেয়াপ্ত করেছেন গোয়েন্দারা। দেহটি ময়না-তদন্তের জন্য আর জি করে পাঠানো হয়েছে। |
ফুলরেণুদেবীর বাড়ির পিছন দিকে দু’টি লেদ কারখানা। পুলিশের অনুমান, কারখানার দিকের পাঁচিল টপকে ঢোকে দুষ্কৃতীরা। বাড়ির পিছন দিকে দুষ্কৃতীদের পায়ের ছাপ এবং পোড়া বিড়ি মিলেছে। এ দিন ফুলরেণুদেবীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশ-কুকুর রাস্তা শুঁকতে শুঁকতে রাজা মণীন্দ্র রোডের দিকে যায়। তা থেকে তদন্তকারী অফিসারদের ধারণা, খুনের পরে দরজার তালা খুলে বেরিয়ে ওই দিক দিয়েই পালিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা।
হিমাদ্রিবাবু জানিয়েছেন, তাঁর দিদির সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল না। তিনি খুব মিশুকে ছিলেন। ফেরিওয়ালা বা অচেনা লোকদেরও ঘরে ডেকে গল্প করতেন। তাঁর সন্দেহ, এই ঘটনার সঙ্গে তেমন কেউ জড়িত। পরিচিত লোক ছাড়া কারও পক্ষে বাড়ির ভিতরে ঢুকে খুনের পরে তড়িঘড়ি চাবি খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কোনও মতেই সম্ভব ছিল না বলেই ধারণা তদন্তকারীদের।
এই ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকাবাসীদের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্দা তপন রায়চৌধুরী বলেন, “এলাকায় চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই। রাতে পাড়া নিস্তব্ধই থাকে। ফুলরেণুদেবীর বাড়ির পিছনে যে কারখানাগুলি আছে, সেগুলিও সন্ধ্যার পরে বন্ধ হয়ে যায়।” পাড়াতেও ওই মহিলা যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন বলে স্থানীয়েরা জানিয়েছেন।
কেন এই খুন, তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্রের খবর, বালা এবং কানের দুল ছাড়া অন্য কিছু খোয়া যায়নি তাঁর। মহিলার ঘর তছনছ করারও তেমন চিহ্ন মেলেনি। এক তদন্তকারী জানিয়েছেন, মহিলার বিছানায় এবং ঘরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছে। টাকাকড়ি হাতানোর উদ্দেশ্যে এলে দুষ্কৃতীরা কেন সেগুলি ফেলে যাবে, তা-ও ভাবাচ্ছে পুলিশকে। গোয়েন্দাদের অভিজ্ঞতা বলছে, লুঠের উদ্দেশ্যে এলে সাধারণত বাড়ির লোকজনকে বেঁধে রাখে দুষ্কৃতীরা। এ ক্ষেত্রে খুন কেন করা হল, তা-ও ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। ফুলরেণুদেবীর কোথায় কী সম্পত্তি রয়েছে, বা সেগুলির উত্তরাধিকারী কে, তা-ও দেখা হচ্ছে।
পুলিশের অনুমান, ঘরে ঢোকার সময়ে কোনও শব্দে ওই বৃদ্ধার ঘুম ভেঙে যায়। দুষ্কৃতীদের চিনে ফেলায় তাঁকে খুন করা হয় কি না, সেই সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, ধুপধাপ শব্দে প্রতিবেশীদের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভয় পেয়ে চম্পট দেয় লুটেরারা। সে কারণেই ফুলরেণুদেবীর বালা বা দুল ছাড়া আর কিছু নিতে পারেনি তারা।
অন্য দিকে, মঙ্গলবার গভীর রাতে বিমানবন্দর থানা এলাকার মধ্যমগ্রামের গ্রিন পার্কে ডাকাতিতে বাধা দিতে গিয়ে জখম হয়েছেন এক দম্পতি। পুলিশ জানায়, ওই রাতে পেশায় ট্রাকচালক দেবেন্দ্র সিংহের বাড়িতে হানা দেয় ডাকাতের একটি দল। দেবেন্দ্র জানিয়েছেন, ডাকাতদের দু’জনের হাতে ছিল রড, এক জনের হাতে ধারালো অস্ত্র। দেবেন্দ্র এক দুষ্কৃতীকে জাপটে ধরলে অন্য জন ভোজালি দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। দুষ্কৃতীদের বাধা দিতে গিয়ে জখম হন দেবেন্দ্রের স্ত্রী যশবিন্দর কউর-ও। ওই দম্পতির চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা জেগে যান। তখনই সেখান থেকে পালিয়ে যায় ডাকাতেরা। খবর পেয়ে আসে বিমানবন্দর থানার পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, দুই প্রতিবেশীর বাড়ির তালা ভাঙলেও কোনও বাড়ি থেকে কিছু লুঠ করতে পারেনি ডাকাতেরা। |