রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন বণিকসভা
নয়া প্রকল্পে মিলছে না অনুমতি, থমকে পুরনোও
গ্নির পথে জটিলতা কাটাতে যখন আবেদনপত্রে পাতার সংখ্যা ৯৯ থেকে কমিয়ে ৭-এ নিয়ে এসেছে রাজ্য, ঠিক তখনই ৫ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সরকারের অনুমতির আশায় দিন গুনছে বলে জানিয়ে দিল বণিকসভা অ্যাসোচ্যাম।
অ্যাসোচ্যামের
অনুষ্ঠানে মহাসচিব
ডি এস রাওয়াত।
—নিজস্ব চিত্র
বুধবার কলকাতায় রাজ্যের শিল্পায়ন ও সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির উপরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে অ্যাসোচ্যাম। অনুষ্ঠান শেষে অ্যাসোচ্যামের সেক্রেটারি জেনারেল ডি এস রাওয়াত জানান, পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে এখনও সংশয়ে শিল্পমহল। এই সংশয় কাটানোর একমাত্র দাওয়াই যে কোনও উপায়ে একটা বড় অঙ্কের লগ্নি টানা। যা প্রমাণ করবে রাজ্য বিনিয়োগ টানতে সত্যিই আগ্রহী। রাওয়াত বলেন, “গত তিন বছরে ৫ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সরকারের অনুমতির অপেক্ষায় আটকে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মন্দার পাশাপাশি সিঙ্গুর পরবর্তী সময়ে লগ্নিকারীদের মনে সংশয়ও অন্যতম কারণ। অধিকাংশ বিনিয়োগকারী যে কারণে ধীরে চলো নীতি নিয়েছেন। সেই সংশয় দূর করার দায় রাজ্যকেই নিতে হবে।”
রাওয়াতের পরামর্শ, “রাজ্যকে সক্রিয় হতে হবে। বিনিয়োগকারীদের জানাতে হবে, যা-ই হোক না কেন প্রকল্পের বাধা দূর করতে সরকার এগিয়ে আসবে। সঠিক পরিবেশ পেলে এখানে বিনিয়োগ আসবে। নচেৎ অন্য জায়গায় চলে যাবে।” রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য পাল্টা দাবি, জিন্দলদের ইস্পাত প্রকল্প, মারুতির লজিস্টিক্স হাব, ইস্কো সম্প্রসারণ প্রকল্প রাজ্যে মোটা বিনিয়োগের উদাহরণ। কিন্তু অ্যাসোচ্যামের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করে ফিকির সেক্রেটারি জেনারেল রাজীব কুমার এ দিন বলেছেন, “এখনও পর্যন্ত কোনও বড় লগ্নি বাস্তবায়িত হয়নি। তার জন্য সময় লাগবে। তবে সরকারকেও মনে রাখতে পুরনো ভুল শোধরানোর চেষ্টা (যা সিঙ্গুরের দিকে ইঙ্গিত করছে বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের অনেক মত) বা কম দামে সম্পত্তি পাওয়ার জন্য লগ্নিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে শিল্পমহলের আস্থায় চিড় ধরতে পারে।”
গত ১৩ অগস্ট তৈরি করা তাদের রিপোর্টে এ রাজ্যে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কয়েকটি অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছে অ্যাসোচ্যাম। যার অন্যতম অবশ্যই জমি পাওয়ার সমস্যা। রিপোর্টে শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে ‘ভয়ের জায়গা’ হিসেবে জমি সমস্যার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, লগ্নির গন্তব্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি এই কারণে খানিকটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বণিকসভাটির মতে, জমি অধিগ্রহণ এবং তার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উপরে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। এই লক্ষ্যে সমস্যা মেটানোর ক্ষমতাসম্পন্ন ‘এক জানালা’ একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষেও সওয়াল করেছে তারা।
অ্যাসোচ্যামের রিপোর্টে স্পষ্ট করে বলা না-হলেও অনেকের মতে, শিল্পের জন্য এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ না করার যে নীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নিয়েছে, শিল্পমহলের দ্বিধাগ্রস্ততার সেটাও একটা বড় কারণ। বহু শিল্পপতিরই মতে, রাজ্যের যা বস্তব পরিস্থিতি, তাতে তাঁদের পক্ষে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে জমি কেনা সম্ভব নয়। আর সরকারের হাতে যে জমি রয়েছে তা এক দিকে যেমন একলপ্তে অনেক বড় নয়, তেমনই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট শিল্পস্থাপনের পক্ষেও অসুবিধাজনক।
জমি সমস্যা নিয়ে শিল্পমহলের এই বক্তব্য অবশ্য এ দিন আরও এক বার অস্বীকার করেছেন পার্থবাবু। তিনি বলেন, “ওরা আমাদের তালিকা দিয়ে জানাক, কোথায় কোথায় জমির অভাবে শিল্প হচ্ছে না। শিল্প গড়তে জেলায় আসুন বিনিয়োগকারীরা। সেখানে জমি আছে। হিন্দুস্তান গ্লাস, টাটা মেটালিক্স জেলায় প্রকল্প গড়ছে।” এ রাজ্যে লগ্নির পরিবেশ নেই, এই অভিযোগও উড়িয়ে দিয়ে পার্থবাবুর দাবি, সম্প্রতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি একটি রিপোর্টে রাজ্যের শিল্পায়ন সম্পর্কে ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। তিনি বলেন, “লগ্নির পরিবেশ নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তাতে দেখা গিয়েছে ,আগে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল ১৮ নম্বরে। এখন ৫ নম্বরে।” মন্ত্রীর প্রশ্ন, রাজ্যের শিল্প সংক্রান্ত ‘কোর কমিটি’-তে অন্যান্য বণিকসভার পাশাপাশি অ্যাসোচ্যামের সদস্যও তো রয়েছেন। তা হলে সেখানে তাঁরা এই সব তথ্য জানাননি কেন?
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম অবশ্য অ্যাসোচ্যামের রিপোর্টকেই হাতিয়ার করে রাজ্য সরকারকে এক হাত নিয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের দাবি, এই রিপোর্টে তাদের বক্তব্যই মান্যতা পেল। তিনি বলেন, “শিল্প, পরিষেবা, কৃষি এই তিনটি ক্ষেত্রেই সরকারের দিক থেকে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। নতুন কিছু হচ্ছে না। পুরনো যা ছিল, তা-ও চলে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানও কমছে।”
অ্যাসোচ্যামের রিপোর্টে জমি সমস্যার কথা বলা হলেও অনুষ্ঠানে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের ১৪ওয়াই ধারায় ছাড়ের আওতায় অনেক শিল্প প্রকল্পকে নিয়ে আসাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। শিল্পমহলের বড় অংশের মতে, জমি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
তবে চলতি শিল্প প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে অ্যাসোচ্যামের রিপোর্টে। বলা হয়েছে, ২০১২-র জুন পর্যন্ত গত এক বছরে ঘোষিত প্রকল্প তৈরির হার টাকার নিরিখে ১৭.৪% কমেছে। অর্থাৎ, ২০১১-র জুন পর্যন্ত গত এক বছরে যত টাকার প্রকল্প তৈরি হয়েছিল, ২০১২-র জুন পর্যন্ত গত এক বছরে হয়েছে তার থেকে ১৭.৪% কম।
তবে তার থেকেও আশঙ্কার হল, কাজ শুরু হয়ে মাঝ পথে আটকে যাওয়া প্রকল্পের অর্থমূল্য। ২০১১-র জুন পর্যন্ত গত এক বছরে ৩২০৪ কোটি টাকার মোট ৪৮টি প্রকল্প থমকে গিয়েছিল। আর ২০১২-র জুন পর্যন্ত গত এক বছরে সেই সংখ্যা মাত্র তিনটি বেড়ে ৫১ হলেও আটকে যাওয়া প্রকল্পের অর্থমূল্য এক ধাক্কায় ৩০২.১ শতাংশ বেড়ে ১২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা হয়ে গিয়েছে। সরকারি সূত্রে এর জন্য বিশ্বব্যাপী মন্দাকে দায়ী করা হলেও শিল্পমহলের পাল্টা বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের পড়শি রাজ্যগুলির ছবি তো এতটা বিবর্ণ নয়।
পরিকাঠামো ক্ষেত্রে রাজ্যের পিছিয়ে থাকা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে অ্যাসোচ্যামের রিপোর্টে। পরিকাঠামো প্রকল্প যে হেতু সাধারণ ভাবে লাভজনক হয় না, এবং প্রকল্পের খরচ উঠতে অনেক দিন সময় লাগে, তাই কেন্দ্রীয় সরকার এই খাতে ভর্তুকি দেয়। প্রশাশনিক পরিভাষায় যে ভর্তুকির নাম ‘ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং’। অ্যাসোচ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী কেন্দ্রের দেওয়া মোট ভর্তুকির এক শতাংশও নিতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ।
এ প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রীর যুক্তি, গত ৩৫ বছরে বাম জমানায় পরিকাঠামো তৈরি করা হয়নি। সেই খামতি মেটানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ করছে নতুন সরকার। অ্যাসোচ্যামের পরামর্শ, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পরিকাঠামো তৈরির উদ্যোগ শুরু হোক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.