ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল...
সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’ শুরুর সেই লাইনই যেন ওঁদের মূলমন্ত্র। ওঁদের কারবারের ‘লাইন’ ছিল কেরোসিন, হয়ে গেল ডিজেল!
বছর পাঁচেক আগে কাটোয়া থেকে অগ্রদ্বীপ যাওয়ার পথে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন সরিফুল শেখ। সঙ্গে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাঁধা নকল ডিজেল বা ‘কাটা তেল’ ভর্তি ২৫ লিটারের দু’টি বড় জ্যারিকেন। কয়েক সপ্তাহ পরেই নদিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে নকল ডিজেল তৈরির কারখানায় হানা দিয়ে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়।
তেলে ‘জল’ মেশানোর সেই কারবারে কিন্তু আজও ভাটা পড়েনি। গত জুনে মঙ্গলকোটের ধারসোনা গ্রামে হানা দিয়ে ১৮০০ লিটার কেরোসিন তেল ও ২৫০ লিটার নকল ডিজেল উদ্ধার করেছিল পুলিশ। অগস্টে কালনার গোয়াড়া মোড়ে নকল ডিজেল কারখানার হদিস মেলে। দু’জায়গা থেকেই গ্রেফতার করা হয় বেশ কিছু কারবারিকে।
জেরায় পুলিশ জেনেছে, কারবারিদের হাতে কেরোসিন আসে তিন ভাবে।
এক, রেশনে পাওয়া তেল কয়েক মাস মজুত রেখে ‘ফেরিওয়ালা’দের কাছে বিক্রি করে দেন গ্রাহকেরা। রেশন দোকানে ১৫ টাকা লিটারে পাওয়া তেল বিক্রি করে মেলে গড়ে ৩৫ টাকা (যদিও ওজনে মারে ফেরিওয়ালারা)।
দুই, কিছু রেশন ডিলার মজুত কেরোসিন চড়া দামে বিক্রি করেন। রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও অনেক উপভোক্তা মাল নেন না। আবার অনেক ডিলারের কাছে ভুয়ো রেশন কার্ড রয়েছে। তা দিয়ে অসাধু ডিলারেরা প্রতি সপ্তাহে বাড়তি কেরোসিন তুলে মজুত করেন। |
তিন, অনেক সময়ে কেরোসিন সরবরাহের গাড়ি থেকেও তেল চুরি করা হয়।
বর্ধমানে কাটোয়া, কালনা বা বর্ধমানের অলিগলিতে দেখা মিলবে ওই ফেরিওয়ালাদের। কেরোসিন কিনতে তাঁরা সাইকেল নিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় ঘোরেন। সঙ্গে থাকে লিটার মাপার যন্ত্র, তাতে দেড় লিটার তেল ঢাললে দেখায় এক লিটার। হাঁক শুনে অনেকেই বেরিয়ে এসে বাড়িতে মজুত কেরোসিন বিক্রি করে যান। দিনের শেষে ফেরিওয়ালারা সেই তেল জমা দেন বা বিক্রি করেন ‘এজেন্ট’দের কাছে।
কাটোয়া শহরের এক এজেন্ট জানান, অগ্রদ্বীপ ছাড়াও নদিয়ার পলাশি, বেথুয়াডহরির আড়পাড়া, মুর্শিদাবাদের সালার থানার গিধগ্রামে অন্তত ৩০-৩৫ জন ফেরিওয়ালার কাজ করেন। তাঁদের মাসিক আয় গড়ে দু’হাজার টাকা। এমনই এক ফেরিওয়ালা বাবু ঘোষ বলেন, “অগ্রদ্বীপে ভাগীরথীর ভাঙনে প্রচুর জমি চলে গিয়েছে। পেট চালাতে এই পথ বেছে নিয়েছি।”
প্রশ্ন হল, প্রশাসন কি এই কারবার আটকাতে পারে না?
রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বক্তব্য, “গ্রাহকেরা কালোবাজারে কেরোসিন বিক্রি করলে আইন অনুযায়ী কিছু করার নেই। তবে খাদ্য দফতর মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালাবে।” তাঁর আশ্বাস, “ডিস্ট্রিবিউটরদের গাড়ি থেকে তেল চুরি আটকাতে জিপিএস ব্যবস্থার সাহায্য নেব। আশা করি, ডিসেম্বর থেকে তা চালু হয়ে যাবে।” গ্রাহক তালিকাতেও কাটছাঁট হচ্ছে। বর্ধমান জেলা খাদ্য নিয়ামক দফতর সূত্রের দাবি, চলতি বছরেই ৭ লক্ষ রেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে।
বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কারসিংহ মিনার বক্তব্য, “শুধু গ্রাহকদের অতিরিক্ত তেল কিনে এই কারবার চালানো সম্ভব নয়। এর পিছনে বড় চক্র রয়েছে। আমি নদিয়ার জেলাশাসক থাকাকালীন এ রকম চক্রের হদিস মিলেছিল। পুলিশ ও খাদ্য নিয়ামক দফতরকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।”
বর্ধমান জেলা খাদ্য নিয়ামক রাজু মুখোপাধ্যায় বলেন, “কাটোয়া-কালনায় বেশ কিছু অসাধু ডিলারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। কয়েক জনকে ‘শো-কজ’ করা হয়েছে। দু’জনকে সাসপেন্ড হয়েছেন।” জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “খাদ্য নিয়ামকের দফতর থেকে তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা সত্যিই বাঁধা যাবে তো? |