অভয়ারণ্য, মেয়েদের জন্য
সে এক আশ্চর্য শহর। মেয়েরা সেখানে অবাধে এবং নির্ভয়ে চলাফেরা করেন। কোনও নিষেধ নেই, কোনও বিপদ নেই। সর্বত্র তাঁরা স্বাধীন, স্বচ্ছন্দ। তাঁদের ওপর পুরুষের নজরদারি নেই। তাঁদের পিছনে নজরদার পুরুষ নেই। ওই শহরে কোনও পুরুষই নেই। সবাই মেয়ে।
কোথায় এই নিশ্ছিদ্র নিরঙ্কুশ প্রমীলারাজ্য? সৌদি আরবে। এখনও তৈরি হয়নি, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে হবে। সে দেশে মেয়েদের জীবনযাত্রায় হাজার বাধা, লক্ষ বেড়াজাল। তাই নিয়ে অনেকের অনেক গঞ্জনা। শুধু বাইরের পৃথিবীর সমালোচনা নয়, সমালোচনায় ক্রমশ মুখর হয়ে উঠছেন ঘরের মেয়েরাও। সেটা অনিবার্য ছিল। দেশে পয়সাকড়ির অভাব নেই, মাটি খুঁড়লেই তেলের ফোয়ারা। মেয়েরাও সেই ঐশ্বর্যের ভাগ পেয়েছেন, আর কোনও কারণে না হোক, পরিবার নামক পাইপলাইন মারফত। তার ওপর আদিগন্ত কমিউনিকেশন গোটা দুনিয়ার মেয়েদের খবর তাঁদের কানে আসছে, চোখে পড়ছে। তাঁরা দেখছেন, শুনছেন, মেয়েরা পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘সব কাজে হাত লাগাই মোরা’ বলে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সব দেখে শুনে সৌদি আরবের মেয়েদের মুখ খুলেছে, বোল ফুটেছে, তাঁরাও চাইছেন নিজের মতো করে বাঁচতে, ঘুরতে ফিরতে, কাজ করতে। কিন্তু সমাজপতি এবং রাষ্ট্রনায়করা সে দাবি মানেন কী করে? মানলে তো তাঁদের দাপট টেকে না, পুরুষতন্ত্রের ভিত নড়ে যায়, ধর্মীয় অনুশাসনের ঝাঁঝ কমে যায়। তা হলে উপায়?
পুরুষ থাকলেই উপায় হয়। মোক্ষম বুদ্ধি বার করেছেন সৌদি আরবের কর্তারা। টাকার অভাব নেই, মরুভূমিতে চাষও হয় না, ফলে জমি নিয়েও সমস্যা নেই, তাঁরা চটপট নতুন শহর বানিয়ে দেবেন, যেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। একটা একটা করে ক্রমশ এমন অনেক শহর তৈরি হবে। সেখানে মেয়েরা কাজকর্ম করবেন, কাজ শেষ হলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাবেন। দরকার মতো থাকার ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই হবে। শহরে যদি শুধু মেয়েরাই থাকেন, তা হলে তো আর তাঁদের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ জারি করতে হবে না, তাঁদের মুখ ঢেকে চলারও কোনও দরকার হবে না। তাঁরা স্বাধীন হবেন।
ভেবে দেখলে এ অতি চমৎকার বন্দোবস্ত। নীতির দিক থেকেও চমৎকার, সুবিধের দিক থেকেও। নীতির কথাই প্রথমে ভাবুন। মেয়েদের প্রথম এবং প্রধান অভিযোগ হল, তাঁদের স্বাধীনতা নেই, সর্বত্র তাঁদের পথ আটকে দেওয়া হয়, তাঁদের নিজেদের ইচ্ছে মতো বিচরণ করতে দেওয়া হয় না, সমাজ বাধা দেয়। তো, আরব দুনিয়ার বুদ্ধিমানরা নিয়মটাই উল্টে দিচ্ছেন। মেয়েদের শহরে পুরুষেরই পথ আটকে দিচ্ছেন তাঁরা। সুতরাং, মেয়েদের আর কিছু বলার থাকল না, এখন বরং পুরুষরা ‘কেন আমাদের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে’ বলে আন্দোলন করতে পারেন, আমাদের এ-দিককার পীড়িত পতি পুরুষ পরিষদ গোছের সংগঠন এ ব্যাপারে সৌদি পুরুষদের উপদেশ-টুপদেশ দিতে পারে।
আবার, সুবিধের কথাটাও অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। পুরুষ নামক জীবটি ধারে কাছে না থাকলে মেয়েদের জীবন অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে, সে কথা বোধ করি একটি কালজয়ী এবং দেশজয়ী সত্য। মফস্সলের স্টেশন রোডে কিংবা মহানগরের নাইট ক্লাবের সামনে অপেক্ষমাণ শিকারি পুরুষদের কথা বলছি না, সেটা প্রাসঙ্গিকও নয়, কারণ ছেলেরা যত উচ্ছন্নেই যাক, পিশাচরা এখনও সংখ্যালঘু। কিন্তু সাধারণ পুরুষ? এমনিতে যাঁরা ঠিকঠাক? একটু আঁচড়ালেই দেখবেন, মেয়েদের ব্যাপারে প্রত্যেকে এক এক জন জ্যাঠামশাই কিংবা বড়মামা, নিদেনপক্ষে মেজদা, শাসনের ভঙ্গিটা সকলের সমান নয়, কেউ বজ্রের মতো কঠোর, কেউ কুসুমের ন্যায় কোমল, কিন্তু শাসন সকলেরই ধর্ম। পুরুষধর্ম। কঠোর হোক, কোমল হোক, এই অবিরত শাসনের দাপট থেকে মুক্তি পেয়ে মেয়েরা নিজেদের শহরে নিজেরা ভালই থাকবেন। মাঝে মাঝে হয়তো মনটা একটু হু হু করে উঠবে, আপেলটি হাতে ধরে এক বার ও দিকে যাওয়ার ইচ্ছে হবে, তা সে তখন গেলেই হয়, শহরে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ, শহর থেকে নারীর নিষ্ক্রমণ তো আর নিষিদ্ধ নয়, কেবল গেটের বাইরে পুরুষ অভিভাবক দাঁড়িয়ে থাকবেন, এই যা।
কট্টর নারীবাদীরাও অনেকেই পুরুষবর্জিত স্বর্গের কথা অনেক দিন ধরে বলে আসছেন। পুরুষের শাসনে অতিষ্ঠ এবং ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা সাব্যস্ত করেছেন, পুরুষকে বাদ দিয়ে দেওয়াই শ্রেষ্ঠ নীতি। পুরুষকে বাদ দিয়ে দিলে পুরুষের শাসনও বাদ চলে যায়, সব ঝঞ্ঝাট চুকে যায়। তা, এমন একটা চূড়ান্ত নারীবাদী সুবিধার আয়োজন শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবে হচ্ছে! মনে হয়, পৃথিবী নামক গ্রহটার মতোই এই গ্রহের তত্ত্বগুলোও স্বভাবে গোলাকার, চরম পুরুষতন্ত্র এবং চরম নারীবাদ শেষ যাত্রায় এক বিন্দুতে মিলে যায়!
পুনশ্চ: মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়ার নামে বন্দি করে রাখার এই কৌশলটির নিন্দেমন্দ করার আগে এক বার মেনে নেওয়া ভাল, মেয়েদের জন্য আলাদা একটা ‘নিরাপদ’ এবং ‘অবাধ’ দুনিয়া গড়ে দেওয়ার এমন উদ্যোগ আমাদের অনেকেরই বেশ ভাল লাগে। কেবল পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও। এই ভাল-লাগাটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, যে মেয়েরা চিরকাল শোওয়ার ঘর, ভাঁড়ার ঘর আর রান্নাঘরের ত্রিভুবন নিয়ে ছিলেন এবং আছেন, তাঁদেরও একটা বিরাট বড় অংশ সেই জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট, এমনকী গর্বিত নিজস্ব জগতের গর্ব। সমস্যাটা ওই ‘নিজস্ব জগৎ’ নিয়েই। ওটা আসলে নিজস্ব জেলখানা। সত্যিকারের মুক্তি খুঁজতে ওই নিজস্ব বৃত্ত ছেড়ে বেরোতে হবে। সৌদি আরবে মেয়েদের জন্য যে বস্তুটি তৈরি হচ্ছে, তার নাম অভয়ারণ্য। অভয়ারণ্যে যে প্রাণীরা থাকে, তারাও যেমন স্বাধীন, অবাধ, ওই মেয়েরাও তেমনই। হুতোম বলতেন, এও অ্যাক স্বাধীনতা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.