দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে
আলোকবৃত্তে
আসেননি।
অথচ, তাঁরা
গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক
মানচিত্রকে
রঙিন করে তুলেছেন।
মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
কোথায় খেজুরি আর কোথায় সাগরের মনসা দ্বীপের রামকৃষ্ণ মিশন হাইস্কুল। ভাবনার দু’প্রান্তে দু’জন মনীষী। রামকৃষ্ণ হিন্দুধর্মের মূল শাখাগুলি হজম করে তাকে বাঁধলেন এক লোকায়ত অমৃত কথায়। যাঁর জন্যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন মাত্র চারটি বাক্যের পদ্যবন্ধে, লোকগুরুর শতবর্ষ স্মরণে: ‘বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা
ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তাঁরা...’
পল্লি উন্নয়ন ও সমাজসেবার মন গড়ে উঠেছে প্রবালের, এই দুই মনীষীর দর্শন ভিত্তি করে।
আর রবীন্দ্রনাথ? বাঙালির অলস কবিসত্তাকে উড়িয়ে-পুড়িয়ে কর্মযোগী রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, পল্লিপ্রেমী, কৃষক রবীন্দ্রনাথ। এই ব্যক্তিত্বের আদর্শের সঙ্গে জীবনভর বাঁধা পড়লেন প্রবালকান্তি হাজরা। সাকিন, পূর্ব-মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার খেজুরি থানার দেউলপোতা গা।ঁ একেবারেই সাদামাঠা চেহারার, দরিদ্র পরিবারের এক যুবকের বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতীর পাঠ শেষে শিক্ষকতা করতে চলে আসা, মনসাদ্বীপের খ্যাতনামা, রামকৃষ্ণ মিশন হাইস্কুলে। প্রায় দু’দশক। পরে, প্রায় এক দশক শিক্ষকতা খেজুরির এক নম্বর ব্লকের কৃষ্ণনগর মণীন্দ্রনাথ হাইস্কুলে। এর মধ্যে লেখার মতোন আছেটা কী? আছে। শোনা যাক সত্তর ছুঁতে চলা প্রবালমাস্টারের মুখে।
“ছাত্রজীবনে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় পড়াশোনার সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ভাবনাটা আমাকে বারে বারে টানত। সামগ্রিক রবীন্দ্রনাথের রূপরেখা আমার পাঠ্য বিষয়েই ছিল, এম এ-তে। যাকে ‘স্পেশাল পেপার’ বলে। এই বিষয়টিকে গভীরতা দেন রবীন্দ্রভারতীর ওই সময়ের উপাচার্য হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। বারে বারে হোঁচট খেতাম, ঠাকুরবাড়ির রবি, সাহিত্য-গান-নাচের কবি, কেমন করে জমিদার কবি হয়ে উঠলেন পল্লিউন্নয়ন, গো-খামার, আলুচাষে উদ্যোগী রবীন্দ্রনাথ। এই খোঁজ থেকেই আজ এখানে পৌঁছানো।” দীর্ঘ পথের কথা প্রবালকান্তির কণ্ঠে।
সেই অনুসন্ধান থেকে প্রবালকান্তির গ্রন্থ প্রকাশ ‘রবীন্দ্রভাবনায় কৃষি-বাণিজ্য ও শিল্প’। এবং অন্য গ্রন্থটি, ‘রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ভাবনার আলোকে আজকের গ্রামোন্নয়ন’। তথ্য হিসেবে গ্রন্থে মুদ্রিত যা কিছু সবই ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনের চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে ও বক্তৃতায়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেই সে দিনের গ্রাম ভাবনা ও কর্মযোগ, আজকের পঞ্চায়েত রাজ-এ কেমন সম্পর্কিত? এই বিষয়টির নির্বাচন প্রবালকান্তির মৌলিক। আজকের একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বার্ধক্য ভাতা, একশো দিনের কাজ, বিপিএল, জননী সুরক্ষা যোজনা“এর অনেকগুলোই ভিন্ন রূপে, ভিন্ন নামে শিলাইদহ-সাজাদপুরে শিক্ষানবীশ জমিদার রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন। পরে, বোলপুর-শান্তিনিকেতনে ‘শ্রীনিকেতন’ সংস্থা, রবীন্দ্রনাথের পল্লি উন্নয়নের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ”, জানালেন প্রবালকান্তি।
ঠিক তাই। পল্লি উন্নয়নকে রবীন্দ্রনাথ বিশেষিত করেন ‘মাতৃদায়’ বলে। পৃথিবীতে এমন কোনও কবির কথা জানা নেই, যিনি পল্লির উন্নয়নের জন্য কৃষিবিদ্যালয় গড়েছিলেন। নোবেল পুরস্কারের এক লক্ষ ষোলো হাজার টাকার পঁচাত্তর হাজার টাকা সঙ্কটে পড়া পাতিসর ব্যাঙ্কে দেন। পুরো টাকাটাই জলে গেল। আফসোস করেননি রবীন্দ্রনাথ। এ সব নানা তথ্য, গ্রাম ও কৃষি বিষয়ক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তা গ্রন্থভুক্ত করেছেন প্রবাল।
আর আপনার জীবনে রামকৃষ্ণ মিশন?
“এম এ, বি এড করে কাঠ বেকার। ডিম ফেরি, ঠোঙা তৈরি, সামান্য জমি চাষ করে নাকানি-চোবানি। সাগরদ্বীপের রামকৃষ্ণ মিশন হাইস্কুলে চাকরি জোটে। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক স্বামী সুপ্রভানন্দ শিক্ষাসত্রে বেঁধে দিলেন আমার অন্য এক বোধকে। শিক্ষকতার জীবনে ওই দ্বীপের সমস্ত মানুষ হয়ে উঠল আত্মীয়। চাকরিটি হয়ে উঠল আনন্দ-কর্ম। এ আমার কাছে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের আশীর্বাদ”। কপালে জোড়-কর ছোঁয়ালেন প্রবাল। প্রবাল এখনও, সত্তর ছুঁতে চলা, সমাজসেবার কাজ করে চলেছেন দুটি অলাভজনক সংস্থার হয়ে। প্রবালের আর একটি গ্রন্থ তা-ও গ্রাম নিয়েই‘গ্রামীণ জীবনরাগের ঝিলিক’। লুপ্ত গ্রাম ও লুপ্ত গ্রামীক জীবিকার নরনারীদের কাহিনি। গ্রাম্য, লাজবতীদের কুয়োতলা বা পুকুর ঘাটের পড়ন্ত আলোয় আড্ডা, ঢেঁকির ধান-চালকোটা, মুড়ি ভাজুনিদের জীবনালেখ্য, আকাশ প্রদীপ, ধর্মগোলা, রাত জাগা চৌকিদার, আলতা পরানোর মাসি, আরও কত শত। পড়তে পড়তে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ঝাঁপি’ ও শান্তি মিত্রের ‘দর্পনে বাংলা’র কথা মনে পড়ে যায়। |