বঙ্গিপুরাপু বেঙ্কটসাই লক্ষ্মণ যে বিদায়ের দোরগোড়ায় নিজের জন্য এমন প্রবল জল্পনাও উৎপন্ন করে ফেলবেন কে জানত! টেস্টে নয় হাজারের কাছাকাছি রান করেও একটা সীমান্ত লক্ষ্মণ কখনও অতিক্রম করতে পারেননি। তা হল, নিজের সম্পর্কে অপরিসীম ঔৎসুক্য তৈরি করতে পারা। বা কোনও জাতীয় জল্পনার জন্ম দেওয়া। যেটা চেষ্টা না করেই করতে পেরেছেন সচিন-রাহুল-সৌরভরা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ষোলো বছর কাটিয়ে ফেলা গোধূলিবেলার লক্ষ্মণ অবশ্য শুক্রবারের ভারতকে আচ্ছন্ন করে দিলেন এক অন্তহীন কৌতূহল হলে। শনিবার কি তিনি ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করছেন?
এমন নয় যে গ্রুপ এসএমএস করে কেউ অভিসন্ধির সঙ্গে খবরটা ছড়াচ্ছিল। ভারতীয় ক্রিকেট অলিন্দে শুক্রবার বিকেল থেকে আপনাআপনিই চাউর হয়ে যায়, হায়দরাবাদে শনিবার সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছেন লক্ষ্মণ। আর সেখানেই জানিয়ে দেবেন নিউজিল্যান্ড সিরিজের পরে ক্রিকেট থেকে অবসর নেবেন। ওই সিরিজের দু’টো টেস্ট যথাক্রমে হায়দরাবাদ আর বেঙ্গালুরুই হবে তাঁর শেষ পদচিহ্ন। খবরটা কি ঠিক? লক্ষ্মণকে ফোনে ধরা গেল না। প্রথমে বেজে গেল। তার পর নট অ্যাভেলেবেল। হায়দরাবাদের সাংবাদিকেরা এমন কোনও সম্মেলনের খবর জানেন না। যা শনিবার ডাকা হয়েছে। কিন্তু তাঁরাও অবসর সংক্রান্ত গুজবের শরিক। কেউ কেউ বললেন, শুনছি রবিবার প্রেস কনফারেন্স ডাকছে।
ফোনে যোগাযোগ করা হলে একাধিক নির্বাচক বললেন তাঁদের কাছে কোনও খবর নেই। কিন্তু খবরটা সত্যি হলে তাঁরা মোটেও আশ্চর্য হবেন না। আনন্দবাজারেই মাত্র ক’দিন আগে বার হয়েছে, নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলেছেন লক্ষ্মণের সঙ্গে। পরামর্শ দিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে দু’টো টেস্ট ম্যাচ খেলে সরে যেতে। লক্ষ্মণ তাঁকে কোনও পাকা কথা দেননি। এখন কি তা হলে লক্ষ্মণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন? |
লক্ষ্মণ দেশের মাঠে গত দু’বছর যথেষ্ট ভাল খেলেছেন। দেশে শেষ ৭ টেস্টে তাঁর মোট রান ৫৯০। গড় ৭৩.৭৫। আর শুধু গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ ধরলে গড় ৯৯.৩৩। শুধু দেশে নয়, গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে লক্ষ্মণ একটা ৯৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন যা তাঁর সর্বকালের সেরার মধ্যে পড়ে। সে জন্যই হয়তো ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধবের কাছে মিডিয়ায় তাঁকে ঘিরে সমালোচনা নিয়ে এত উষ্মা প্রকাশ করেছেন লক্ষ্মণ। কিন্তু শুধু মিডিয়া তো নয়, দেশের ক্রিকেটার মহলও একমত- দ্রাবিড়ের পর ভ্রাতা লক্ষ্মণেরও এ বার বানপ্রস্থে যাওয়ার সময় হয়েছে।
এর কারণ শোচনীয় সাম্প্রতিক ফর্ম। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে শেষ ৮ আন্তর্জাতিক ইনিংসে মাত্র ১৫৪ রান করেছেন লক্ষ্মণ। এর আগে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েও সম্পূর্ণ ব্যর্থ। নির্বাচকেরা যে দিন ভারতের প্রাথমিক দল নির্বাচনের সভায় বসেন, উত্তরাঞ্চল নির্বাচক মোহিন্দর অমরনাথ প্রথমেই বলেন, “রান না পাওয়াটা বড় ব্যাপার নয়। লক্ষ্মণের ফিটনেসটাই তো গেছে।” বাকিরাও একমত হন। বলতে থাকেন, পেসারের জন্য না হয় স্লিপে দাঁড়াল। বাকিটা সময় ধোনি ওকে কোথায় রাখবে? শ্রীকান্ত তখন বলেন, তিনি নিজে কথা বলবেন লক্ষ্মণের সঙ্গে। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করেন লক্ষ্মণের চিন্তাভাবনা অন্য। তিনি মরসুমের পুরো দশটা টেস্ট খেলতে চান। অবসর নেবেন ২০১৩ ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুর্থ টেস্ট খেলে উঠে। লক্ষ্মণের সেন্টিমেন্ট ছিল যে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশেল ছোঁড়ার জন্য তিনি এত প্রসিদ্ধ, সেই ফেভারিট টিমের বিরুদ্ধে খেলে তিনি অবসর নিতে চান। শ্রীকান্ত পাল্টা তখন বলেন, “এত বড় ঝুঁকি নিও না। আমরা থাকব না সেপ্টেম্বর থেকে। নতুন কমিটি। তারা তোমার মতো প্লেয়ারকে যদি বসিয়ে দেয়, অসম্মানের একশেষ হবে।”
শ্রীকান্ত যেটা বলেননি তা হল, নতুন কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনা মোহিন্দরের। আর তিনি আসা মানে স্রেফ ফিটনেস ইস্যুতেই লক্ষ্মণকে সরিয়ে দিতে হবে। শেষ নির্বাচনী বৈঠকে এক নির্বাচক বলেছেন, “রাহুল ফিট থেকেও চলে গেছে। আর এ তো পরিষ্কার আনফিট।” কিন্তু লক্ষ্মণকে বাদ দিয়ে ভারতীয় মিডল অর্ডার সামলাতে পারবে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং? শুক্রবার রাতে জবাবে প্রভাবশালী নির্বাচক বললেন, “টিম তৈরি আমাদের করতেই হবে। সচিনের কথা আলাদা। রাহুল নিজেই চলে গেছে। লক্ষ্মণ যদি ঘণ্টা শুনতে না পায়, ওকে জোর করে শোনাতে হবে।” শোনা গেল, লক্ষ্মণ নিউজিল্যান্ড সিরিজ খেলে অবসর নেওয়ার ব্যাপারে নিমরাজি হওয়ায় নির্বাচকেরা ধোনিকে দায়িত্ব দেন, তুমি কথা বলে ওকে বোঝাও। ধোনি কথাও বলেন এর পরে।
হায়দরাবাদে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা কি এ সবেরই নিট ফল? না কি স্রেফ জল্পনা? কৌতূহলের পারদ তাঁকে ঘিরে ক্রমশ চড়ছে। কবে হবে তাঁর বৈঠক? শনি? রবি? না কি হবেই না?
ভিভিএস লক্ষ্মণ অন্তত বিদায়বেলায় এসে গোটা এক দিনের জন্য আর জাতীয় কাব্যে উপেক্ষিত নন। |