গরুর গাড়িতে মাটির তৈরি বাঘ। তার পিঠে চড়ে বসেছে সাপুড়ে। মুখে মনসার গান“মাগো বিষহরি, তোমায় স্মরি”। সাপুড়ের ডান হাতের মুঠিতে ধরা কালো খরিশ জিভ বের করছিল। তখন বাঁ হাত পাকিয়ে ছিল চন্দ্রবোড়া।
পিছনের ভ্যান রিকশায় আরও সাপ-সাপুড়ে। ভ্যানের উপরের ঝাঁপি খুলে একে একে তাঁরা বের করছেন বিভিন্ন ধরনের সাপ। আধো অন্ধকারে মন্দির নগরীর রাস্তায় সাপ নিয়ে এই ‘মিছিল’ দেখতে ভিড় করেছিলেন দর্শকেরা। সাপুড়ের হাতে কিলবিল করছিল সাপ। আর দর্শকেরা দূর থেকে দেখে আঁতকে উঠছিলেন। বাগীশ পাড়া, শাঁখারিবাজার থেকে প্রায় জনা কুড়ি সাপুড়ে শতাধিক সাপ নিয়ে শুক্রবার বিকেলে রাজদরবার পর্যন্ত গেলেন। প্রতিবারই মনসা উপলক্ষে বিষ্ণুপুরে এই ঝাঁপান উৎসব হয়। সপ্তদশ শতক থেকে চলছে। |
সামনে-পিছনে মিছিলে মাইকে বাজছিল বাংলা ও হিন্দি গান। পাথরের রথকে এক পাশে রেখে লাল ধুলোর রাস্তায় মল্ল রাজত্বের স্মারক ছোট গড়দরজা ও বড় গড়দরজা পেরিয়ে সাপুড়েদের মিছিল যখন রাজদরবারের মাঠে পৌঁছল সূর্য তখন অস্তাচলে। জ্বলে উঠল জেনারেটরের নানা রঙের আলো। সাপের খেলা দেখাতে শুরু করলেন উত্তম পাল ও গোপাল ধীবররা। জিভে, কানের লতিতে, শরীরের নানা অঙ্গে সাপ ঝুলিয়ে চলতে থাকল কেরামতি।
বিষ্ণুপুরের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ তথা বিষ্ণুপুর মিউজিয়ামের সচিব চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, “বর্ষাকালে এই এলাকায় মনসা পুজো হয়। সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মনসার আরাধনা। সপ্তদশ শতকে শ্রাবণ সংক্রান্তিতে বিষ্ণুপুরে মল্লরাজারা মন্ত্রবলে সাপকে বশে আনার খেলা দেখানোর ঝাঁপান উৎসবের সূচনা করেছিলেন। উপঢৌকনও দিতেন তাঁরা। এখন রাজসমাদর সে ভাবে না জুটলেও ঐতিহ্যের টানেই আসেন সাপুড়েরা।”
উৎসবটি এখনও টিম টিম করে টিকিয়ে রেখেছেন শাঁখারিবাজার দশর কালীমাতা ঝাঁপান উৎসব কমিটি ও বাগীশ পাড়া মুনলাইট ক্লাব। দশর কালীমাতা ঝাপান কমিটির সভাপতি দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বিষ্ণুপুর পুরসভা এবং বিষ্ণুপুর মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সামান্য আর্থিক সহযোগিতায় বহু কষ্টে এই লোক উৎসবটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি। কতদিন চালু রাখা যাবে জানি না।” হেতিয়া গ্রাম থেকে খেলা দেখাতে আসা উত্তম পাল, লালমোহন রায়রা বলেন, “আমাদের পূর্ব পুরুষরা এখানে আসতেন। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরাও আসি। টাকার জন্য নয়, হাজার হাজার মানুষের সামনে খেলা দেখিয়ে আনন্দ পাওয়ার ও আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি।” দর্শকেরা যে খুশি হয়েছেন, সাপুড়েদের বুক পকেটে দশ-বিশ টাকা দিতে দেখেই বোঝা গেল। |