রহস্য গভীর
ত্রিচক্র ভয়ঙ্কর
রিবর্তন হল, কিন্তু উন্নয়ন হল না!
হাওড়ায় পুলিশ কমিশনারেট হল। মেট্রো রেলের কাজ শুরু হল। কিন্তু কলকাতা ঘেঁষা শহর হাওড়া তার পুরনো খোলস বদলাতে পারল কি?
উত্তর না। সঙ্কীর্ণ, ঘিঞ্জি শহরে রিকশার দাপাদাপি কম হওয়া দূর অস্ত, বর্তমানে তা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। ফলে পথ চলাই কার্যত দায় হয়ে উঠেছে মানুষের। তাঁরা মনে করছেন, হাওড়া হয়ে উঠেছে রিকশা নগরী!
অথচ হাওড়া পুরসভার লাইসেন্স দফতর বলছে, ২০০৬-এর পরে আর রিকশার লাইসেন্স নবীকরণই হয়নি। ওই সময়েই শহরে লাইসেন্সধারী রিকশার সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৮০০। আর এখন তা তিরিশ হাজারেরও বেশি। তবে মাঝে ২০০৮-এ সামান্য কয়েকটি রিকশার লাইসেন্স নবীকরণ হয়েছিল। ২০০৬-এ হাওড়া পুরসভার তৎকালীন মেয়র সিপিএমের গোপাল মুখোপাধ্যায় ও জেলাশাসক রাস্তায় নেমেছিলেন বেআইনি রিকশা ধরতে। কিন্তু তার পরে পুরসভা ও পুলিশ, কারও তরফেই বেআইনি রিকশা বন্ধ করার কোনও অভিযান হয়নি বলেই অভিযোগ হাওড়াবাসীর।
বাস্তব চিত্র বলছে, শুধু দিনে নয়, রাতেও শহর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন চাকার এই যান। শুধু হাওড়া শহরাঞ্চলই নয়, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, সাঁকরাইল, জগৎবল্লভপুর, মেদিনীপুর ও আমতা থেকেও আসছে রিকশা। সঙ্গে আসছে অপরিচিত চালকও। হাওড়া সিটি পুলিশের দাবি, এই চালকদের অনেকের হাত ধরেই হাওড়া শহরে ঢুকছে অপরাধ। রাতের অন্ধকারে অনেক রিকশাচালক জড়িয়ে পড়ছেন অসামাজিক কাজের সঙ্গে। যদিও সমস্ত দিকেই কড়া নজর রাখা শুরু হয়েছে বলে দাবি এক পুলিশকর্তার।
পুলিশ সূত্রে খবর, রাতে যে সব রিকশা শহরে ঢুকছে, তাদের অনেক চালকের মূল কাজ হল গাঁজা, চোলাই-সহ বিভিন্ন নেশার দ্রব্য সরবরাহ করা। রিকশার আসনের নীচে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে সেই সব জিনিস। কেউ কেউ আবার রাতের অন্ধকারে চুরি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। আর যে সব রিকশাচালক এ ধরনের অসামাজিক কাজ করছে তাদের বেশির ভাগেরই লাইসেন্স নেই।
যদিও পুরসভা সূত্রে খবর, বর্তমানে কোনও রিকশার লাইসেন্সই নবীকরণ করা হচ্ছে না। রিকশাচালকেরাও এ বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছেন না। আর এখানেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে পুলিশকর্তাদের মধ্যে। তাঁদের কথায়, কেন বহু রিকশাচালক বৈধ কাগজপত্র করাতে চাইছেন না, সেটা পরিষ্কার নয়। এক পুলিশকর্তা বলেন, “বেশ কয়েকটি ঘটনার পরে দেখা গিয়েছে, কিছু রিকশাচালক বিভিন্ন অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাই এখন প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট রিকশাচালকের উপরেও নজর রাখা হচ্ছে।”
রাতের অসামাজিক কাজের পাশাপাশি দিনের বেলাতেও ত্রি-চক্রব্যূহে পড়ে যাচ্ছে হাওড়া। সব থেকে ভয়ঙ্কর অবস্থা হাওড়া ময়দান চত্বরের। বাসিন্দাদের কথায়, মেট্রো রেলের কাজের জন্য এমনিতেই স্তব্ধ হয়ে পড়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্র হাওড়া ময়দান। বাস, হকার, পথচারী সব মিলিয়ে প্রাণান্তকর অবস্থা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রয়েছে রিকশা। হাওড়া ময়দান চত্বরের সঙ্গে সংযোগকারী বিভিন্ন গলিরও একই অবস্থা। হাঁটাচলার প্রায় উপায় নেই।
একই অবস্থা শহরের অন্যান্য এলাকারও। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে রিকশার দাপট। পুলিশ-প্রশাসন, আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই একমুখী রাস্তা থেকে শুরু করে সর্বত্র অবাধ বিচরণ তিন চাকার এই যানের। বারে বারে অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলে মেলে রিকশাচালকের দুর্ব্যবহার। কমিশনারেট হওয়ার পরে হাওড়া শহরে যানবাহনের গতি বেড়েছে ঠিকই, তবে রিকশার দাপটে সেই গতি মাঝেমধ্যেই থমকে যায় বলে অভিযোগ ট্রাফিক পুলিশকর্মীদের।
হাওড়া শহরে এই মুহূর্তে দিনে প্রায় ৩২ হাজার রিকশা চলে। ২০০৬ সালে তৎকালীন মেয়র প্রশাসনিক স্তরে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রথমে এলাকা ভাগ করা হবে। তার পরে যে সব রিকশা লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করেনি তাদের ধরা হবে। এর পরে বেআইনি রিকশা বাজেয়াপ্ত করবে পুলিশ। কিন্তু আদপে তা কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
রিকশা নিয়ে কী বলছে পুলিশ ও পুরসভা? হাওড়া সিটি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (ট্রাফিক) অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, “পুলিশ নিজে থেকে রিকশা ধরতে পারে না। তবে রিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরসভাকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা কিছুই জানায়নি। তারা চাইলে আমরা সহযোগিতা করতে রাজি আছি।” কিন্তু, হাওড়ার মেয়র সিপিএমের মমতা জয়সোয়ালের দাবি: “পুলিশের হাতে আমরা লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশার তালিকা তুলে দিয়েছি। পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে রিকশা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পুলিশ যদি বেআইনি রিকশা ধরার অভিযান চালায়, তবে পুরসভা সব সময় সহযোগিতা করবে। কিন্তু বেআইনি রিকশা বাজেয়াপ্ত করে কোথায় রাখা হবে পুলিশ তা নির্দিষ্ট করতে না পারায় সমস্যা রয়েই গিয়েছে।”
তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “রিকশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পুরসভার দেখার কথা। কিন্তু বেআইনি রিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য মেয়র কি কখনও পুলিশ কমিশনারকে জানিয়েছেন? আসলে বিগত বছরগুলিতে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া নিয়ে অনেক কারচুপি হয়েছে।” হাওড়া জেলা সিটু নেতা নিমাই সামন্ত বলেন, “হাওড়ার বড় সমস্যা রিকশা। এক দিনে নয়, দীর্ঘ দিন ধরে ওই সমস্যা বেড়েছে। কয়েক বছর আগে পুরসভা উদ্যোগী হয়েছিল রিকশা নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়নি।”

ছবি: রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.