|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ১... |
|
অন্য চিত্রাঙ্গদা |
পুরুষালি রাজকন্যা? নাকি, বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শরীরী রূপান্তর?
রবীন্দ্রনাথের
নায়িকাকে অন্য
আলোয়
দেখলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ফল, যৌনতা নিয়ে
আধুনিক চিন্তায় উজ্জ্বল
এক বাংলা ছবি। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
আর দুই সপ্তাহ পরেই বাংলা সিনেমার পানাপুকুরে ধাক্কা দেবে এক কালচার শক! আগামী ৩১ অগস্ট রিলিজ করছে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘চিত্রাঙ্গদা’। সে ছবির বহু দৃশ্যে ঋতুপর্ণ আর যিশু সেনগুপ্ত পরস্পরকে আদর করছেন, চুমু খাচ্ছেন। এমনকী, লিঙ্গ পরিবর্তনের অপারেশন টেবিলে যাচ্ছেন ঋতুপর্ণ। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনি পুরুষ থেকে নারী হয়ে উঠতে চান।
আর সেখানেই ছবির গুরুত্ব। সিনেমাটা ভাল না খারাপ, ভাববেন সমালোচকেরা। কিন্তু আধুনিক বাঙালির যৌনচেতনায় এসেছে সত্যিকার ‘সাবালকত্ব’? ছকবাঁধা নারী-পুরুষ প্রকল্পের বাইরে বিকল্প যৌনতাকেও নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারছে সে? সিনেমার গণ্ডির বাইরেও নানা সামাজিক প্রশ্নের ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হয়ে উঠতে পারে এই ছবি।
সিনেমাটা দেখা গেল দিল্লিতে, ‘ওসিয়ান’ উৎসবের শেষ দিনে। উৎসবের এক দশকে এই প্রথম ‘ক্লোজিং ফিল্ম’ হিসেবে বাংলা ছবি। দিল্লির আমলা ও অভিজাতবর্গের পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের উৎসাহী ছেলেমেয়েরাও সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে ভিড় করে দেখল এই ছবি। দর্শকাসনে আমার পাশে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনা চারেক ছাত্রছাত্রী। ছবি শেষের পর তুমুল হাততালি!
১৪ দিন পর, নিজের শহরে এই হাততালি পাবেন পরিচালক? এটাই সম্ভবত ঋতুপর্ণর সবচেয়ে নৃশংস এবং শরীরী ছবি! মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘অন্তরমহল’ ছবির দৃশ্যটা। রজঃস্বলা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের হাহাকার। চোখের জল আর রক্ত যেন মিলেমিশে একাকার। কিন্তু এই ছবির নৃশংসতা তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। ছবি শেষের পর এক আড্ডায় পরিচালককে বলেওছিলাম সেই কথা। হাসছেন ঋতুপর্ণ, “আমার কোথায় অবাক লাগে জানেন? যে দর্শক ওই দৃশ্য নিতে পারল না, সে-ই আজ সিনেমায় গালিগালাজ শুনে হাততালি দিচ্ছে।” আমাদের আড্ডায় একটি শর্ত ছিল। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তখন এক সাক্ষাৎকারে ‘ডি ফোকাস্ড হয়ে গিয়েছিল ঋতুদা। কেন পরপর অভিনয় করতে গেল’ ইত্যাদি নানা কথা বলেছিলেন (পত্রিকা, ৪ অগস্ট)। ফলে প্রসেনজিৎ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না।
আর দুই সপ্তাহ পরে বাঙালি ঋতুপর্ণকে প্রশ্ন করবে, না হাততালি দেবে, সেই প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু একটা কথা অস্বীকারের উপায় নেই। ‘চিত্রাঙ্গদা’ই ঋতুপর্ণ ঘোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে আন্তর্জাতিক ছবি। যৌনতার নতুন তত্ত্বের আলোয় রবীন্দ্রনাথকে পড়ে ফেলেছেন ঋতু।
রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’র মোদ্দা গল্পটা কী? মণিপুর রাজবংশে শিবের আশীর্বাদে শুধু ছেলে হয়। এ বার চিত্রাঙ্গদা নামে এক মেয়ে জন্মাল। বাবা তাকে শিকার, যুদ্ধবিদ্যা, রাজ্যশাসন শিখিয়ে ছেলের আদলে গড়ে তুললেন। তার পর অর্জুনকে দেখে মুগ্ধ রাজকন্যা মদনের কাছে বর চাইল। এ বার সে হতে চায় ললিত নারী। কুরূপা চিত্রাঙ্গদা হবে সুরূপা।
ছবিতে রুদ্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক ডান্স-ডিরেক্টরের চরিত্রে ঋতুপর্ণ। দলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ‘চিত্রাঙ্গদা’ নামাচ্ছেন তিনি। এবং ‘টাইট্ল কার্ড’-এর আগেই জানিয়ে দেন, ‘চিত্রাঙ্গদা আসলে একটি ইচ্ছের গল্প। বাবার ইচ্ছে ভার্সাস চিত্রাঙ্গদার ইচ্ছে।’ এটিই ছবির নির্যাস। ছবি যত এগোয়, বোঝা যায়, রুদ্রর বাবা (দীপঙ্কর দে) তাঁর ছেলের মেয়েলি ভাব, নাচ করা পছন্দ করেন না। তবু রুদ্র তার প্রেমিক পার্থকে (যীশু) ভালবেসে শরীরের রূপান্তর ঘটাতে চায়, মেয়ে হয়ে উঠতে চায়। মহাকাব্যিক প্রেমের রাবীন্দ্রিক নৃত্যনাট্যে এ ভাবেই অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছেন ঋতুপর্ণ।
অন্তর্ঘাত কোথায় না নেই? গানের কথাগুলিই ধরা যাক! ছেলে থেকে মেয়ে হওয়ার জন্য অপারেশন টেবিলে ঋতুপর্ণ। সামনে সবুজ মাস্ক পরা ডাক্তার, ওপরে উজ্জ্বল আলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান, ‘বঁধু, কোন আলো লাগলো চোখে।’ অপারেশন থিয়েটারের আলোর মধ্যেও কি মিশে নেই প্রেমের দূরাগত, ঝাপসা স্মৃতি? |
|
আর এই অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসম্মান নয়, বরং সেগুলির অমিত শক্তির দিকেই যেন নির্দেশ করেন ঋতুপর্ণ। বাংলার অন্যতম উৎস সংস্কৃত ভাষাতেও লিঙ্গের ব্যাপক প্রাবল্য। ‘সে বলেছে’ বাক্যটা পুংলিঙ্গে এক রকম, স্ত্রীলিঙ্গে এক রকম। ‘বাংলা ভাষা সেই তুলনায় নির্লিঙ্গ। এখানে সর্বনামে লিঙ্গের পরিবর্তন হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে বাংলা ভাষার এই শক্তিটা বারেবারে ধরেছেন। যেমন, ও যে মানে না মানা গানটা। শুধু ব্যাকরণ বিচার করে এই ‘ও’ ছেলে না মেয়ে, কিছুতেই বোঝা যায় না,’ সম্প্রতি ‘বাংলায় লিঙ্গপ্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ’ নামের এক প্রবন্ধে সে দিকেই নির্দেশ করেছিলেন কালচারাল স্টাডিজের অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। “প্রবন্ধটা আমাকে খুব নাড়িয়েছিল,” বলছেন ঋতুপর্ণ।
আর সেখান থেকেই নতুন ব্যাখ্যা। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের শেষটা মনে আছে? আত্মবিশ্বাসে দীপ্ত এক নারী, ‘পূজা করি রাখিবে মাথায়, সে-ও আমি নই, অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে পিছে, সে-ও আমি নই।’ এখানে রুদ্র তার পার্টনারের জন্য মেয়ে হতে গিয়েছিল। সে জন্য অনেক অস্ত্রোপচার। কিন্তু এক জায়গায় এসে থমকে যায় সে। কোমরে অস্ত্রোপচার মেনে নেবে রুদ্র? তা হলে কী ভাবে নাচবে সে? আর সেই থমকে-যাওয়া মুহূর্তেই যেন হঠাৎ শিল্পীর নবজন্ম। নারী-পুরুষ যেই হোক, আমাদের ‘সেক্সুয়াল পার্টনার’কে খুশি করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় নিজস্ব স্বর হারিয়ে ফেলি। কিন্তু শিল্পী? তাঁকে তো আপস করলে চলবে না, নিজস্ব স্বর নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।
আর ‘চিত্রাঙ্গদা’ই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। অজস্র কুৎসা সত্ত্বেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই নাটক নিয়ে ছিলেন অনড়। নাটকটি ছেপে বেরোনোর পর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রেগে গিয়েছিলেন, অর্জুনের প্রতি চিত্রাঙ্গদার প্রেম নিবেদন পছন্দ হয়নি তাঁর। লিখেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে চিত্রাঙ্গদা হইলে দেশ উৎসন্ন যাইবে।’ সেই চিত্রাঙ্গদাই আজ, ঋতুপর্ণর মেধাবী পরিচালনায় বিকল্প যৌনতার ‘টেক্সট’।
গুরুত্ব কোথায় নেই? রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদাকে মণিপুরের রাজকন্যা বলে বর্ণনা করলেও মূল মহাভারতে রাজ্যটি সমুদ্রের ধারে, তার নাম মণিলুরা। এখনকার ওড়িশার কাছে। ছবিতে ঋতুপর্ণ, যিশু আউটিং-এ যান কোণার্কের সূর্যমন্দিরে। রাবীন্দ্রিক ভুলটি সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়েছেন ঋতুপর্ণ।
পারিবারিক রাজনীতি বরাবরই ঋতুপর্ণর ছবিতে অন্য মাত্রা পায়। যে বাবা রুদ্রর মেয়েলিপনা সহ্য করতে পারতেন না, হাসপাতালে তিনিই ছেলেকে ডাকতে আসেন, “বাড়ি চলো। মা তোমার ঘরের জন্য অনেক পর্দা কিনেছেন।” বাবা কি আজও পর্দার আড়ালে ঢেকে রাখতে চান রূপান্তরকামী পুত্রকে?
যৌনতার আধুনিক তত্ত্ব বলে, দুনিয়ায় আদতে সমকামী-বিসমকামী কোনও মেরু নেই। সকলের মধ্যেই লেসবিয়ান, গে এবং রূপান্তরকামী আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। হোমোসেক্সুয়াল বনাম হেটেরোসেক্সুয়ালের দ্বিমেরু বিভাজন নিতান্তই অর্বাচীন। ১৯২০ সালের আগে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতেও ‘হোমোসেক্সুয়াল’ শব্দটি ঢোকেনি। হোমো গ্রিক শব্দ, সেক্সুয়ালিটি লাতিন। দুয়ে মিলে ওই হাঁসজারু শব্দ।
আসলে, প্রত্যেকেই নিজের শরীরকে অদম্য ভালবাসে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। নিজেকে ভালবাসার জৈবনিক ইচ্ছে চাপা দিতেই লোকে সমকামী, রূপান্তরকামীদের নিয়ে আতঙ্কে ভোগে। ছবিতে ঋতুপর্ণ তাই জরুরি এক প্রশ্ন তোলেন। জন্মগত শরীর নিয়ে আমরা যদি সুখী হই, তা হলে ছেলেরা চুল, নখ কাটে কেন? মেয়েরা কান বেঁধায় বা উল্কি আঁকে কেন?
এই ছবি শুধু হোমোসেক্সুয়ালিটি বা রূপান্তরকামিতা নিয়ে নয়। ছবির শেষে যীশু এবং রাইমার বিয়ে। তার পর মাদকাসক্ত হয়ে ঋতুপর্ণের কাছে টাকা চাইতে আসেন যীশু। ঋতু চেক দেন এবং এক থাপ্পড় মারেন। তৃতীয় লিঙ্গকে অকারণ ভিক্টিম বানায়নি ‘চিত্রাঙ্গদা’, বরং তাকে জয়ের মুকুট পরিয়েছে।
আর ছেলে থেকে মেয়ে হওয়ার জন্য শরীরী কাটাছেঁড়ার এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথ? সেখানে তো নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া, হ্যালিউসিনেশন এবং আরও অনেক কিছু। চমৎকার অভিনয় করেছেন অঞ্জন দত্ত। ছবির শেষে সমুদ্রের ধারে এক মেঘলা সকালে তিনি জানান, ‘কোনও রূপান্তরই সম্পূর্ণ নয়। পদ্ধতিটা চলতেই থাকে।’ আর দর্শক হাততালিতে ফেটে পড়ে।
আড্ডায় অনেক কথাই হয়েছিল... |
প্রশ্ন: ‘আরও একটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর পর এবার নিজের ছবিতে। |
ঋতু (হাসি): একটাও আমার নিজের চরিত্র নয়।
|
প্রশ্ন: জানি। কিন্তু ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘দহন’ থেকে চিত্রাঙ্গদা... কোন চরিত্রে আপনার আত্মজৈবনিক উপাদান সবচেয়ে বেশি? |
ঋতু: ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী।
|
প্রশ্ন: কেন? |
ঋতু: বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ অবিচার করেছেন। কামুক মহেন্দ্র সংসার পেল, কিন্তু বিনোদিনী নয়। আমি নিজেকে ওই ভাবেই আইডেন্টিফাই করি।
|
প্রশ্ন: ছবিতে আপনার দুই প্রেমিক। যীশু ও সঞ্জয় নাগ। দু’জনেরই দাড়ি। এমনকী অঞ্জন দত্তেরও তাই। দাড়ির প্রতি এই আকর্ষণ কেন? |
ঋতু: দাড়ি কখনও কখনও ছদ্মবেশ। ধরুন, আপনি বাইসেক্সুয়াল। কিন্তু দাড়ি রাখুন, স্ত্রী সংসার নিয়ে থাকুন, মেনস্ট্রিম সমাজে চমৎকার মিশে যাবেন। কেউ প্রশ্ন করবে না।
|
প্রশ্ন: ইউরোপ, আমেরিকার সিনেমায় আজকাল বিকল্প যৌনতার চমৎকার ব্যবহার। ইতালিতে পেদ্রো আলমাদোভার। অন্য দিকে সঁ পেনের ‘মিল্ক’ বা হিথ লেজারের ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’ অস্কার পাচ্ছে। এ দেশে সে রকম হয় না কেন? |
ঋতু: ছুঁৎমার্গ। এখানে কোনও নায়ককে স্মাগলার, সিরিয়াল কিলার ইত্যাদি চরিত্রে অভিনয় করতে বলুন, প্রশ্ন করবে না। সে জানে, লোকে এ জন্য তাকে খুনি ভাববে না। কিন্তু গে বা ট্রান্সজেন্ডার করতে বলুন। সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে যাবে। তাদের ধারণা, লোকে এর পর তাদের ওই রকম ভাববে।
নাহ, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আমাদের কোনও কথা হয়নি। |
|
|
|
|
|