সম্পাদকীয় ১...
গণতন্ত্রের বিপদ
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় কিছু মৌলিক কথা মনে করাইয়া দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, গণতন্ত্রের যেগুলি প্রধান প্রতিষ্ঠান, শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা এবং আইনসভা, সেগুলির মর্যাদা এবং স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ করিলে গণতন্ত্রকেই আঘাত করা হয়। জন-আন্দোলন যদি ক্রমাগত বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করিয়া এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে আঘাত করিতে থাকে, তাহা হইলে গণতন্ত্রই আক্রান্ত হইবে। রাষ্ট্রপতির এই সতর্কবার্তার মূলে যথেষ্ট যুক্তি রহিয়াছে, সদ্ভাবনাও রহিয়াছে। গণতন্ত্র এক দৃষ্টিতে জনজীবনে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য এবং আত্মীয়তার প্রকাশের উপায়। এই অর্থে গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক, সামাজিক দর্শন। এমনকী তাহা জীবনের অর্থ, জীবনযাপনের পথ নির্দিষ্ট করে, মানুষে-মানুষে সম্পর্কের মূল ভিত্তিটি রচনা করে, সেই অর্থে ইহাকে ‘ধর্ম’ও বলা চলে। কিন্তু রাষ্ট্রজীবনে গণতন্ত্রের সেই আদর্শের যে প্রকাশ, তাহা প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য এবং মর্যাদা রক্ষার মাধ্যমেই হয়। সংবিধান তাহার মূল, এবং সংবিধান-নির্দিষ্ট আইন-কানুন, মন্ত্রক-দফতর, ন্যায়-নীতি, বিধিব্যবস্থা তাহার প্রধান আশ্রয়। এই সকল বিধিব্যবস্থায় একাধিক মত প্রকাশের পরিসর নির্মাণ করা হইয়াছে সযত্নে, সুতরাং প্রায় যে কোনও প্রতিষ্ঠানে বিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত লইবার সুযোগও রহিয়াছে। বিরোধী মতের প্রতি সৌজন্য ও মর্যাদা গণতন্ত্রের প্রাণভ্রমর বলা যাইতে পারে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ৭৫ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে ইহা বলিয়াছেন। তিনি বিধানসভাকে গণতন্ত্রের ‘পীঠস্থান’ অভিহিত করিয়া বিরোধী ও শাসকদলের একত্রে কাজ করিবার অঙ্গীকার মনে করাইয়া দিয়াছেন।
গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলি যদি তাহাদের নির্দিষ্ট কাজগুলি করিত, তাহা হইলে দৈনন্দিন নিয়মপালনেই গণতন্ত্রের পরিপুষ্টি ঘটিত। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলি প্রায়শই আমলাতান্ত্রিক। দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্নীতি এবং বিবিধ পক্ষপাতের দ্বারা আক্রান্ত। জনসুবিধার প্রতি তাহারা উদাসীন, নাগরিকের প্রতি স্বচ্ছ বা দায়বদ্ধ নহে। এই কারণেই সেগুলির প্রতি নাগরিকের অনাস্থা জন্মিয়াছে, এবং আন্দোলন করিয়া নাগরিকের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করিবার চেষ্টা চলিয়াছে। গণ-আন্দোলনও গণতন্ত্রে জনজীবনেরই অংশ, তাহা আবশ্যকও বটে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করিলে গাছের ডালে বসিয়া তাহাতেই কুঠারাঘাত করার তুল্য হইবে। গণতন্ত্রে মানুষে মানুষে সাম্য এবং সমানাধিকার রাখিবার কাজটি তখনই সম্ভব যখন গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকিবে। বিচারব্যবস্থা যে শাসনব্যবস্থাকে তাহার সীমা লঙ্ঘন করিলে বাধা দেয়, আবার বিচারব্যবস্থা যে আইনসভার নির্দিষ্ট সীমা লঙ্ঘন করিতে পারে না, এমন পরস্পর সীমা নির্দেশের জন্যই নাগরিকের নিরাপত্তা ও মর্যাদা লঙ্ঘিত হইতে পারে না। রাষ্ট্রজীবনে প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির ভারসাম্যই সমাজজীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করিতে পারে।
তবে রাষ্ট্রপতি যাহা উল্লেখ করেন নাই, তাহাও এই স্থলে স্মরণ করা প্রয়োজন। তাহা হইল, মর্যাদার যোগ্য না হইলে মর্যাদা দাবি করা চলে না। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংবিধান মর্যাদা দিয়াছে বলিয়াই সাধারণ মানুষ সম্মান করিবে, এমন আশা করিলে ভুল হইবে। গণতন্ত্রে শাসনব্যবস্থাকে মানুষের প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল এবং সক্রিয় করিবার কাজটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই মৌলিক কাজটির প্রতি উদাসীন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাঁহারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্য ব্যবহার করেন। যাঁহাদের উপর জনসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার ন্যস্ত করা হয়, সেই মন্ত্রী-আমলাদের ব্যক্তিগত সম্পদ অকল্পনীয় হারে বাড়িতে থাকে। এমনকী জনপ্রতিনিধির পদটি পর্যন্ত পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হইয়া যায়। গণতন্ত্রের এমন অবমাননার ক্ষোভই নানা নাগরিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সেই আন্দোলনের অনেক নেতা ভ্রান্তিতে আক্রান্ত, ইহা সত্য। কিন্তু যাঁহারা গণতন্ত্রের কাণ্ডারি, সেই জনপ্রতিনিধিরা কি গণতন্ত্রকে সম্মান করেন? না হইলে তাঁহারা কী করিয়া সম্মান দাবি করিতে পারেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.